সাল ২০১৪-১৫ হবে। সদ্য মাধ্যমিক পাশ করা যুব সমাজ তখন প্রবেশ করে ফেলেছে এই অন্তর্জালক দুনিয়ায়। পরিচয় ঘটেছে ইউটিউবের সঙ্গে। আর সেই ইউটিউবের ‘ভগবান’ হয়ে উঠেছেন যুব সমাজের কাছে, ভুবন বাম। নিজের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে তাঁর ইউটিউব চ্যানেল, ‘বিবি কি ভাইনস’ এর রাজত্ব তখন তুঙ্গে। সকলের মুখেই এই এক নাম! তাঁকে দেখেই উদ্বুদ্ধ হয়, নদীয়ার ধুবুলিয়া জেলার এক অষ্টাদশীর কিশোর। কে জানত, বাংলায় একদিন তাঁর হাত ধরেই আসতে চলেছে, ইউটিউব জগতের নতুন সকাল?
সেই কিশোর হলেন, আজকের ‘দ্য বং গাই’ কিরণ দত্ত। আজ ১৫ জুলাই, কিরণ পা দিলেন সিলভার জুবিলীতে। পঁচিশ বছর আগে রাজস্থানের জয়সলমিরে, কালীপদ দত্ত ও ডালি দত্তের কোল আলো করে আসেন, আজকের ইউটিউবের নক্ষত্র কিরণ দত্ত। তাঁর বাবা সেন্ট্রাল গভর্মেন্টের অধীনে থাকায় ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কিরণ এবং তাঁর দাদা কৌশিকের শৈশব যাপন হয়েছে। পরবর্তীকালে বাবা বাইরে থাকলেও, মা এবং দাদার সঙ্গে নদীয়ার ধুবুলিয়ায় চলে আসেন ছোট্ট কিরণ। সেখানেই হাতে খড়ি হয় তাঁর। প্রথম শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণী ধুবুলিয়ার আদ্যমা রামকৃষ্ণ মিশনে পঠন পঠন করে, পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন দেশবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ে। ছোট থেকেই ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলেন ‘বং গাই’। তখন থেকেই স্কুলে প্রথম হওয়ার সঙ্গে, মাধ্যমিকে তাঁর স্কুলের হয়ে, এবং উচ্চমাধ্যমিকেও তাঁর ব্লক থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
এরপরই কড়া নাড়ে ‘ক্রাইসিস’। উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে পরপর একাধিকবার জয়েন্ট দিয়েও, আশানুরূপ ফল করতে পারেন না ‘বং গাই’! কলকাতায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়তে এসেও, ব্যর্থতার মুখ দেখতে হয় তাঁকে। তাঁর সঙ্গে ভেঙে পড়েন পরিবারও। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবার, সন্তান পড়াশুনা করে দাঁড়াবে এমন মনোভাবই হয় সংসারের ভিত। কিন্তু সেখানে কিরণের জীবনে নেমে আসছে একের পর এক দুর্বিষহ পরিস্থিতি। কিন্তু তিনি যে কিরণ দত্ত! “হারকে জিতনেওয়ালো কো হি…” ‘দ্য বং গাই’ কেহেতে হে! হয়তো এই ব্যর্থতাই ছিল কিরণের সংগ্রামের সোনার কাঠির ছোঁয়া! যার ফলে কিরণের এক নিদ্রিত সত্তার জাগরণ ঘটে ‘বং গাই’ হিসেবে।
ছোটবেলায় কিরণের বাবার একটি মাল্টিমিডিয়া ফোন ছিল। কিরণ নিজের মত গান গেয়ে, শর্ট ফিল্ম বানিয়ে সেভ করে রাখতেন সেখানে। বড় হতে হতে যখন তিনি নিজেই ‘টেক স্যাভি’ হয়ে উঠলেন, তখনই তাঁর মাথায় আসে ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করার কথা। প্রথম দিকে তাঁর আগের ভিডিওগুলিই পোস্ট করতে থাকেন। বন্ধুদের গুগল একাউন্ট খুলিয়ে চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার বাড়ান। এমনকি চ্যানেল গ্রো করার জন্য নিজেও একাধিক গুগল একাউন্ট খুলে সাবস্ক্রাইব করতে থাকেন। কিন্তু প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয় না। ফেসবুকে ‘বং নোটিফিকেশন’ নামে এক পেজ খুলে তৎকালীন সময়ের তাঁর তৈরি করা মজাদার ভিডিও পোস্ট করতে থাকেন কিরণ। এই পেজটিই বলা যায় তাঁর জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’। হঠাৎই তাঁর পোস্ট ঘিরে তৈরি হয় আলোড়ন। বাড়ে ভিউয়ার্সের সংখ্যা। চ্যানেলের নাম পরিবর্তন করে হয়ে যায় ‘দ্য বং গাই’! ফেসবুক পেজের জনপ্রিয়তাকে পাথেয় করে ইউটিউবেও একই নামের চ্যানেল খোলেন তিনি… তারপর? তারপর তা ভারতে বাংলার ইউটিউবের ইতিহাসে এক সফল এবং উজ্জ্বল পথ চলার পরিচয় বয়ে নিয়ে চলছে।
কিরণকে আজ সারা ভারত চেনে। বলা যায় তাঁর জীবনে ব্যর্থতা এলেও তা তাঁর সাফল্যেরই চাবিকাঠি ছিল। কিরণ প্রত্যেক ছেলেমেয়ের অনুপ্রেরণা। প্রত্যেক বাঙালির ঘরের সদস্য তিনি। তাঁর নতুন সফরের জন্য রইলো আন্তরিক শুভেচ্ছা। এগিয়ে যান কিরণ, এগিয়ে যাক প্রথম বাংলা ইউটিউবারের দেখানো পথের অনুসারীরা।
Image Credit: Fact Sider