নীল নদ! নামটা শোনামাত্রই চোখের সামনে ইতিহাসের পাতাগুলি যেন উল্টে যেতে থাকে। আচমকা ফিরিয়ে নিয়ে যায় মিশরীয় সভ্যতায়। আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত নীল নদ, পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা ছিল, এই নীল নদ কেন্দ্রিক। নদী কেন্দ্রিক মহাদেশ বলে, আফ্রিকায় কখনও জলের অভাব ঘটেনি। নদীর পার্শ্ববর্তী জমিও উর্বর ও ফসলোপযোগী হয়ে উঠেছে নীল নদের কল্যাণে। বন্ধুরা, আজ আমরা আপনাদের সেই নীল নদের তীরে সফর করাবো। তো চলুন, আর দেরি না করে রওনা দেওয়া যাক।
আমাদের প্রাকৃতিক সম্পত্তির অন্যতম প্রধান সম্পদ হল নদী। বহু প্রাচীন থেকে আধুনিক সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। যেকোন নদীই বিভিন্ন পর্বত বা হিমবাহ থেকে সৃষ্ট হয়ে, বহন করে নিয়ে চলেছে আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক সভ্যতার ইতিহাস। কোনো নদীর উৎস বা গতিপথ ধরে, অন্য নদীর সঙ্গে তুলনা করা সহজ ব্যাপার নয়।
জলপ্রবাহের দিক দিয়ে আমাজন সবথেকে বড় নদী হলেও, উৎস থেকে গতিপথ বিস্তারে সবচেয়ে দীর্ঘ নদী হল নীল নদ। নীল নদের দৈর্ঘ্য ৬৬৯৫ কিলোমিটার। অনেকেই ভেবে থাকেন নীল নদ হয়তো কেবল মিশরের অন্তর্বর্তী নদী, কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়। আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় এগারোটি দেশ নীল নদের তীরে অবস্থান করেছে। এই দেশগুলি হল, মিশর, সুদান, দক্ষিণ সুদান, ইথিওপিয়া, উগান্ডা, কঙ্গো কেনিয়া, তানজানিয়া, রোয়ান্ডা, বুরুন্ডি এবং ইরিত্রিয়া। শ্বেত নীল নদ এবং নীলাভ নীল নদ হল, নীল নদের দুটি বিশিষ্ট উপনদী। এই দুটি উপনদীর মধ্যে, শ্বেত নীল নদ হল দীর্ঘতম। শ্বেত নীল নদের উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতান্তর রয়েছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, আফ্রিকার বৃহত্তম হ্রদ, ভিক্টোরিয়া থেকে এর উৎপত্তি হয়েছে। এই হ্রদের উত্তর প্রান্তে রয়েছে রিপন জলপ্রপাত। এই জলপ্রপাত থেকে উৎপন্ন একটি ক্ষীণ জলধারা থেকে শ্বেত নীলের জন্ম। মূলত বহু ঝর্ণার জল এসে ভিক্টোরিয়া হ্রদে মিশেছে। ফলে রিপন জলপ্রপাত থেকেই যে শ্বেত নীলের উৎপত্তি এটা দাবি করা যায় না। এটি সর্ব দক্ষিণে রোয়ান্ডা থেকে উৎপন্ন হয়ে, উত্তরে তানজানিয়া উগান্ডা ও দক্ষিণ সুদানের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে। অপরদিকে ইথিওপিয়ার টানা হৃদ থেকে উৎপন্ন হয়ে নীলাভ নীল নদ সুদানের দিকে বয়ে চলেছে। উল্লেখ্য, সুদানের রাজধানী খার্তুমের কাছে এই দুই উপনদী নীল নদের, মিলিত হয়েছে। নীল নদ সর্বশেষে ভূমধ্যসাগরে পতিত হওয়ার আগে, বিশাল বদ্বীপ সৃষ্টি করতে করতে উদ্যত হয়েছে।
বন্ধুরা, আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন, আবার অনেকেই জানেন না, আপনাদের সকলের সুবিধার জন্য জানিয়ে রাখি, নাইল বা নীল শব্দটি এসেছে, নাহল থেকে। গ্রীক মহাকবি হোমার তাঁর ইলিয়াড মহাকাব্যে, নীল নদকে ইজিপটাস নামে অভিহিত করেছেন।
শুধু মিশর নয়, নীল নদকেন্দ্রিক সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী দেশ হল সুদান। তাই সুদানিজদের কাছে নীল নদ বিভিন্ন স্থানীয় নামে পরিচিত। নামগুলি হল, আলনিল, আল বাহর, এবং বাহার আল নীল বা নাহার আল নীল।
বন্ধুরা, শুনলে অবাক হবেন, নীল নদের এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে যা অন্য নদীর মধ্যে চোখে পড়েনা। যেমন অন্য নদীতে জল হ্রাস পেলে নীল নদে বৃদ্ধি পায়, আবার বিপরীত ভাবে নীল নদে জল হ্রাস পেলে অন্য নদীতে জল বৃদ্ধি পায়। দক্ষিণ থেকে উত্তরে বয়ে চলা এই নদীটি বছরের সবচেয়ে উষ্ণতম সময়, কিভাবে বন্যায় প্লাবিত হত, তা প্রাচীন মিশরীয় ও গ্রিকদের কাছে ছিল এক অজানা রহস্য। মিশরের মরুভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে নীল নদের উত্তরাংশের প্রায় পুরোটাই। মিশরীয় সভ্যতার ভিত ছিল নীল নদ। যা এখনও স্পষ্ট ভাবে লক্ষিত। মিশরের বেশিরভাগ শহর নীল নদের অববাহিকায় অবস্থিত। প্রাচীন মিশরের বেশিরভাগ ঐতিহাসিক স্থাপত্যও নির্মিত আছে নীল নদের তীরে। সেই কারণে মিশরকে বলা হয়ে থাকে নীলনদের দান।
প্রাচীন মিসরীয়রা এই সদা প্রবাহমান নদীটির নাম দিয়েছিল, অরু বা অর। যার অর্থ দাঁড়ায়, কালো। এর একটি বিশেষ কারণ আছে। কারণ প্রতিবছর বন্যায় নীল নদ, তার আশেপাশের জমিতে বিপুল পরিমাণে কালো রঙের পলি বয়ে আনতো। তখন যেন মনে হতো সমগ্র অঞ্চল কালোর আঙিনায় ছেয়ে গেছে। বলা বাহুল্য, সমৃদ্ধ এই কালো রঙের পলি মিশরকে শস্য শ্যামলা করে তুলতো। এই পলি জমিকে উর্বর করে বিভিন্ন মরশুম ফসল দান করতো, এবং মিশর নদীমাতৃকা দেশ হওয়ার সৌভাগ্য ভোগ করত। নীল নদের বন্যার কারণে তৈরি বদ্বীপ অঞ্চলে, বহু প্রাচীন কাল থেকেই জনবসতি গড়ে উঠেছিল।
আপনারা শুনলে আশাহত হবেন, এত সমৃদ্ধশালী, ইতিহাস আশ্রয়ী নীল নদ উত্তরোত্তর শুকিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ১৯৭০ সালে, Aswan High Dam নামে একটি বাঁধ নির্মাণের ফলে নীল নদে আর কোনও বন্যাই হয়না। কারণ, এই বাঁধের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বাড়িতে জল পরিষেবা ইত্যাদি বিভিন্ন কার্যসিদ্ধির জন্য নীল নদের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। কালের প্রবাহে মানুষকে চিরকাল সমৃদ্ধিলাভ করে নীল নদ, আজ নিজেই নিঃস্ব। যদিও মিশরের অত্যধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধিও নীল নদের এই কারুন্যের অন্যতম মূল কারণ। বর্তমানে মিশরের জনসংখ্যা প্রায় দশ কোটির কাছাকাছি। ধারণা করা হচ্ছে আগামী পঞ্চাশ বছরে এই সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হবে। উল্লেখ্য, এই বর্ধিত জনসংখ্যার প্রায় ৯৫ শতাংশই নীল নদের জলের ওপর নির্ভরশীল।
বন্ধুরা, আপনাদের আগেই বলেছি, নীল নদ আন্তর্জাতিক নদী হিসেবেও মিশরসহ আরও দশটি দেশের অধীনে। তার মধ্যে সুদানও ঠিক মিশরের মত নীল নদের জলের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল। মাথাপিছু জলের প্রাপ্যতা অনুসারে মিশর ইতিমধ্যেই পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলির একটি। মার্কিন মুলুকের একজন নাগরিকের জন্য বরাদ্দকৃত জলের বাৎসরিক পরিমাণ ৯৮০০ ঘনমিটার, অপরদিকে মিশরের একজন নাগরিকের বরাদ্দকৃত জলের বাৎসরিক পরিমাণ ৬৬০ ঘনমিটার। মিশরসহ অন্যান্য দেশগুলির জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জলের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে নীল নদ হয়ে উঠছে ম্রিয়মাণ।
আপনারা জানেন কি, আফ্রিকার প্রায় ৩০ কোটি মানুষ নীল নদের জলের ওপর সরাসরিভাবে নির্ভরশীল। এমনকি নীল নদের জলবন্টন নিয়ে এই নদী কেন্দ্রিক দেশগুলির মধ্যে একটি পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা আছে। নীল নদের জল ব্যবহারে কে বেশি প্রাধান্য পাবে, তার জন্য ১৯৫৯ সালে মিশর ও সুদানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর পর্যন্ত হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রতি বছর মিশর পাবে ৫৫.৫ বিলিয়ন ঘনমিটা র জল এবং অপরদিয়ে সুদান পাবে ১৫.৫ বিলিয়ন ঘনমিটার জল। মিশরের নীল নদ বাহিত ৮০ শতাংশ জল আসে ইথিওপিয়া থেকে। কিন্তু সেই চুক্তিতে ইথিওপিয়া বা বাকি অন্যান্য দেশগুলির মধ্যে জলের বণ্টন কেমন সাধিত হবে সেই নিয়ে কোন বিস্তারিত তথ্য উপলব্ধ ছিলনা। এর ফলে আফ্রিকার দেশগুলির মধ্যে জলের চাহিদা বাড়ায় সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে অসন্তোষ। এতগুলো বছর পরেও দেশ গুলির মধ্যে কোন বনিবনা সংঘটিত হয়নি। বরং মিশর ও ইথিওপিয়ার উচ্চাভিলাসী জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নীল নদের মধ্যে জলের চাহিদা বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণ। এর প্রেক্ষিতে কেনিয়া তানজানিয়া উগান্ডার মত নদী কেন্দ্রিক দেশগুলি নীল নদের বেসিন শাসনের জন্য একটি নতুন সমবায় আইনের পক্ষে জোর সরব হয়েছে। নীল নদের মতোই দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক জল বণ্টন নিয়েও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।