১৯২৯ সালে, ২৮ সেপ্টেম্বর! ইন্দোরে পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকরের বাড়িতে, লক্ষ্মী নয়, বরং সরস্বতী আসেন ঘরে। বাবার কাছেই শুরু হয় তাঁর সঙ্গীতে হাতে খড়ি। কিন্তু বিধি বাম! মাত্র তেরো বছর বয়সে পিতৃ বিয়োগ ঘটে হেমার। পরিবারের হাল ধরার জন্য অভিনয় জগতে পা রাখেন আজকের সুর সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর।
লতার কোকিল কণ্ঠী সুর, ততদিনে মন ছুঁয়েছে আত্মীয় পরিজনদের। ছবিতে অভিনয়ের বদলে, গান গাওয়ার সুযোগ পেতে থাকেন তিনি। একটি মারাঠি ছবির জন্য ১৯৪১/১৯৪২ সালে প্রথমবার গান রেকর্ড করেন। শুরু হয় পথ চলা। লতা চেয়েছিলেন, নিজেকে আরও ঘষে মেজে নিতে। পাড়ি দেন মুম্বইয়ে। ওস্তাদ আমান আলী খানের কাছে শুরু হয় ধ্রুপদী গানের চর্চা। এরপরই বলিউডের মত এক বড় জগতে, নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে শুরু করেন সুর সম্রাজ্ঞী।
৩৬ টিরও বেশি ভাষায় জাদুকাঠি ছুঁয়েছেন এই সুর-ঈশ্বরী। গানের সংখ্যা ত্রিশ হাজারেরও বেশি। ইন্দো চীন যুদ্ধে নিহত বীর শহীদদের উদ্দেশ্যে গান গেয়েছিলেন লতা। তাঁর কণ্ঠে ‘অ্যয় মেরে ওয়ার্তন কী লোগো…’ গানটিতে চোখের জল বাধ মানেনি এমন মানুষ নেই। স্বয়ং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু পর্যন্ত লতার কণ্ঠের প্রভাবে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন।
ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে লতা মঙ্গেশকরই প্রথম, যিনি ঐতিহ্যবাহী রয়াল আলবার্ট হলে সঙ্গীত পরিবেশনা করেন। আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর এই প্রথম পরিবেশনা সঙ্গীত ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করে।
সুরের সম্রাজ্ঞী হলেও, পথ যে মসৃণ ছিল তাঁর, সে কথা স্বীকার করা একেবারেই ভুল। ‘শহীদ’ ছবির প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায় লতা মঙ্গেশকরকে গায়িকা হিসেবে মনোনীত করতে রাজি হননি। ছবির সংগীত পরিচালককে তিনি জানান, লতার গলা বড়ই মৃদু! এমন গলা তাঁর ছবির গানের জন্য ‘বেমানান’!
সাত দশক ধরে একাই প্রায় সঙ্গীত জগতের রাজ্যপাট সামলেছেন লতা। এই প্রজন্মের গানেও তাল মিলিয়েছেন ভারতীয় সুরজগতের ‘নাইটেঙ্গল’। ‘বীর জারা’ ছবিতে জগদিত সিংয়ের সঙ্গে লতার যুগলবন্দতে ‘তেরে লিয়ে’ গানটি, যে কোনও বয়সী শ্রোতার চোখে আজও জল এনে দেয়।
সুর সম্রাজ্ঞীর মুকুট ভারী হয়েছে, একাধিক পুরস্কারের পালকে। ১৯৮৯ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে পুরস্কৃত হন লতা মঙ্গেশকর। ২০০১ সালে ভারতরত্ন প্রদান করা হয় এই সুরের সাধিকাকে।
২০১৯ সালই ছিল এই কোকিল কণ্ঠীর কণ্ঠের সাক্ষী থাকার শেষ বছর। এই বছরেই ভারতীয় সৈনিকদের শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে শেষ গান রেকর্ড করেন তিনি। গানটি ছিল ‘সৌগন্ধ মুঝে ইশ মিটটি কী’।
আজ লতা মঙ্গেশকরের ৯৩ তম জন্মদিবস। তিনি যে সুরের দেবী! আর দেবীদের অন্ত নেই। তিনিও তাই, চির প্রবাহমান। আসমুদ্রহিমাচল একই ভাবে তাঁর সুরের ছন্দে মেতে ওঠে। প্রেম হোক বা বিরহ, তাঁর গানের প্রতি শব্দ জীবন্ত হয়ে বুকে বিঁধে থাকে। আজ তাঁর জন্মদিবসে, টেক টকির পক্ষ থেকে রইল আন্তরিক শ্রদ্ধার্ঘ্য।