‘বন্দ দেব গজানন বিঘ্ন বিনাশন। নমঃ প্রভু মহাকায় মহেশ নন্দন।।’ সিদ্ধিদাতা গণেশ হলেন বিঘ্ন বিনাশক। ভাদ্র এবং মাঘ মাসের শুক্লা চতুর্থী হল গণেশ চতুর্থী। হিন্দুমতে, এইদিন হল পার্বতী-নন্দন গণেশের জন্মদিন। ছোট্টখাট্ট নাদুশ নুদুস চেহারার এই দেবতা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য সকলের খুব প্রিয়। হিন্দু পূরাণে তাঁকে নিয়ে প্রচলিত আছে বিভিন্ন মজাদার গল্প। গণেশের জন্মলগ্ন নিয়েও কথিত আছে এক চমকপ্রদ কাহিনী। গণেশ নাকি দেবী পার্বতীর গর্ভজাত সন্তান নন। একদা পার্বতী হলুদ গুঁড়ো দিয়ে এক মূর্তি তৈরি করেছিলেন স্বর্গলোকে। চেতনায় পুত্রলাভের কামনাকে সংরক্ষিত রেখে, মূর্তি নির্মাণে মগ্ন ছিলেন দেবী। তাঁর অজান্তেই সেই মূর্তি রূপ ধারণ করে এক ছোট্ট বালকের। সেই প্রাণহীন আদলের মধ্যেই তিনি যেন খুঁজে পান, তাঁর পূত্রলাভের বাসনার পরিপূর্ণতা। দৈববলে তৎক্ষণাৎ প্রাণ প্রদান করেন সেই মূর্তিতে। মূর্তি হয়ে ওঠেন জীবন্ত। পার্বতী নাম দেন ‘গণেশ’।
গণেশকে পার্বতী আদেশ দেন, তিনি যখন স্নানাগারে থাকবেন, গণেশ যেন হন তাঁর দেহরক্ষী। গণেশও মায়ের আবদার মত তা পূরণ করবার জন্য অগ্রণী হন। কিন্তু এবার ঘটে যায় সেই বিপর্যয়। মহাদেব গণেশের আবির্ভাবের সম্মন্ধে তখনও অবগত হননি। পার্বতীর কাছে আসতে গিয়ে গণেশ দ্বারা তিনি বাধাপ্রাপ্ত হন। ক্রুদ্ধ মহাদেব তৎক্ষণাৎ মুন্ডচ্ছেদ করেন তাঁর নিজেরই সন্তানের। এমতাবস্থায় কান্নায় ভেঙে পড়েন পার্বতী। পার্বতীর এই করুন অবস্থা মহাদেব সহ্য করতে পারেন না। গণেশকে পুনরায় জীবিত করবার জন্য প্রয়োজন নতুন মস্তকের। তাহলে উপায়? উপায় হিসেবে দাঁড়ালো, মহাদেব জঙ্গলে গিয়ে যে পশুর দর্শন প্রথম পাবেন, তারই মস্তক হবে গণেশের। জঙ্গলে অনুসন্ধানকার্যে মহাদেব প্রথমেই দর্শন পান এক ঐরাবতের। তাকেই বধ করে, তার মস্তক প্রযুক্ত করে গণেশের দেহে, পুনরায় ফেরানো হয় গণেশের প্রাণ। এই ভাবেই গড়ে ওঠে গণেশের ‘গজানন’ হয়ে ওঠার কাহিনী।
অন্যান্য দেবতার তুলনায় ছোটদের বেশি কাছের হয়ে থেকেছেন গণেশ। কারণ গণেশের বাল্যলীলার গল্পগুলি বেশ সাদরে গৃহীত হয়ে থাকে শিশু-মহলে। যেমন গণেশের বিশ্ব ভ্রমণের গল্পটি প্রায় সব শিশুরই জানা। একবার পার্বতী তাঁর দুই পুত্র, কার্তিক এবং গণেশকে বলেন, যে আগে বিশ্ব ভ্রমণ করে আসতে পারবে, তাঁকে পার্বতী দেবেন তাঁর একটি রত্নহার। ময়ূর বাহনের উপস্থিতির জন্য কার্তিক এই আদেশে যারপরনাই উচ্ছ্বসিত হন। বলা যায়, তিনি নিজেকে নিয়ে অহং বোধ করেন। তিনি বাহনের সঙ্গে বিশ্ব ভ্রমণে বেরিয়ে গেলে, গণেশ কিন্তু ঘিরে থাকেন তাঁর মা পার্বতীকে। পার্বতীকে ঘিরেই গণেশ কয়েক পা ঘুরপাক খান। বিস্মিত পার্বতী এই কার্যের হেতু জানতে চাইলে, ছোট্ট গণেশ জানান, তাঁর মা’ই হলেন তাঁর পৃথিবী! তাই আলাদা করে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার দরকার আর তাঁর নেই। আহ্লাদিত পার্বতী পুত্রের এরূপ আচরণে প্রসন্ন চিত্তে তাঁকে জড়িয়ে ধরেন।
আজ গণেশ পুজো। হিন্দুদের বিশ্বাস, গণেশ যেহেতু বিঘ্ন-নাশক, তাই বাহন ইঁদুরের সঙ্গে, তিনি পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তে যেতে সার্থক হন। এবং যেখানে যা বিপদ আছে, তার বিনাশ ঘটিয়ে আসেন। তাই এই পুজো খুব ঘটা করে পালন করা হয়। এছাড়া সিদ্ধিলাভের প্রতীক বলে বাঙালির পয়লা বৈশাখেও পুজো করা হয় গণেশের। সেদিন তাঁকে এবং সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীকে সাক্ষী রেখে খোলা হয় নতুন হাল খাতা। গণেশ চতুর্থীও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ জাঁকজমক ভাবে পালন করা হয়। বাঙালিদের মধ্যে গণেশ পুজো বিশেষ উদ্দীপনার। কারণ বাঙালি জাতি মনে করেন, গণেশ পুজো দিয়ে শুরু হয় বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বন, আর ঠিক এই পুজোর পরেই আসে বাঙালির আবেগ, দুর্গা পুজো। তাই গণেশ পুজো নিয়ে বাঙালির উত্তেজনা বেশ তুঙ্গে থাকে বরাবর। প্রত্যেকের সুস্বাস্থ্য, সুসমৃদ্ধির কামনা করেই সংঘটিত হয়ে থাকে গণেশ পুজো।