আর্জেন্টিনার এক তথাকথিত বস্তি কবলিত গ্রাম রোজারিও।রোজারিওর এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান লুইস লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কিন্তু এই ছেলের পা যেন, ফুটবল নিয়ে তুলির টান দিয়ে বেড়ায় সবুজ ঘাসের ক্যানভাসে। সমবয়সী বন্ধুমহলে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠে এই বিস্ময় বালক! ফুটবলের প্রতি তাঁর শৈল্পিক ছোঁয়া, বন্ধুদের কাছে করে তোলে তাঁকে ‘মেশিন অফ ১৯৮৭’। কিন্তু, ‘রাজারও যে অসুখ করে!’ এই ছেলের জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় শারীরিক প্রতিকূলতা। স্পেনের ফুটবলার কার্লোস রেকসচ উৎসাহী হন এমন বিস্ময়ের প্রতি! যাবতীয় খরচের ভার তিনি নেবেন, এমন অঙ্গীকারে ‘দেবদূত’ এর মত ঢাল হয়ে দাঁড়ান কিশোর ফুটবলারটির জীবনে। আর্জেন্টিনা থেকে চোখ ভর্তি স্বপ্ন নিয়ে, ছেলেটি পাড়ি দেয় স্পেন।
সেই শুরু। ছোট্ট মেসির স্বপ্নালু চোখ তাঁর প্রিয়জনদের থেকে তাঁকে দূরে করলেও, তাঁকে বিশ্ব দরবারে আজ পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। এখন সারা বিশ্ব তাঁর সঙ্গে আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। স্পেনে থাকা শুরু করলেও, নিজের দেশ আর্জেন্টিনার হয়ে মাঠে নামেন ফুটবলের এই অধীশ্বর। ২০০৬ ছিল তাঁর বিশ্বকাপে অভিষিক্ত হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ। সেই শুরু! তারপর মেসিকে, মেসি হয়ে থাকার জন্য করতে হয়েছে একের পর এক সংগ্রাম। কখনও ফাইনালে উঠেেও বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে, কখনও বা সেই অবধি তিনি পৌঁছতে পারেননি। তাঁর সঙ্গে অঝোরে অশ্রু বর্ষণ করেছেন তাঁর অগণিত অনুরাগী।
১৮ ডিসেম্বর, ২০২২! মেসির জীবনে রূপকথার সোনার কাঠিকে বাস্তবে ছুঁইয়ে দেওয়ার পালা! প্রতিপক্ষ ভয়ংকর বিধ্বংসী ফ্রান্স। সারা বিশ্ব তাকিয়ে, বাম পায়ের জাদুর প্রতীক্ষায়! কিন্তু হায়, সময় যে দ্রুত পেরিয়ে যায়! খেলা একেবারে মার মার কাট কাট! হৃৎপিণ্ডের ওঠা নানার পারদ তখন ছাড়িয়েছে এভারেস্টের উচ্চতা। দু দেশই চরম ভাবে, সম অবস্থানে লড়াই করছে। একাধিক বার অতিরিক্ত সময় পেরিয়ে গিয়ে অবশেষে অবতীর্ণ হওয়া টাই ব্রেকারে! আর সেখানেই গন্তব্যে পৌঁছল মেসির নীল সাদা সফরের রথ। এ যেন স্লিপিং বিউটির ঘুম ভাঙ্গা! এ যেন প্রভু শ্রী রামের পরশে পাথর রুপী অহল্যার শাপ মোচন! এ যেন মাউন্ট ভিসুভিয়াসের আকস্মিক কঠিন গর্জন! মেসি পারল! মেসি জিতিয়ে দিল আফগানিস্তানের ‘প্ল্যাস্টিক মেসি’ তথা মোর্তজাকে। মেসি জিতিয়ে দিলো বাংলাদেশের পরিত্যক্ত জঞ্জালে বেড়ে ওঠা ছোট্ট হীরাকে, মেসি জিতিয়ে দিলো সংসারের হাল না ধরতে পারা ব্যর্থ যুবককে। মেসি প্রতিনিধিত্ব করে সকল হারকে আজ জয়ের উত্তরীয় পরিয়ে দিল।
২০২২ মেসির শেষ বিশ্বকাপ। এই বিশ্বকাপ মেসির ‘সৃষ্টিসুখের উল্লাসে’ উদযাপিত হল। তিনি আবার প্রমাণ করলেন, কাঁদন বা বন্ধন যেমন জীবনে আসে, তেমনই হাসি বা মুক্তির আকাশও প্রসারিত হয়। আমাদের কেবল আমাদের লক্ষ্যে কঠিন ভাবে অবিচল থাকতে হবে। তাহলেই আমাদের জীবনে সহস্র বন্ধন মাঝে, মহানন্দময় মুক্তির স্বাদ গ্রহণ সুনিশ্চিত হবে।