“ইয়ে দুরিয়া, ফিলহাল হে…”! সাময়িক নয়, এক জীবনব্যাপী বিচ্ছেদ যন্ত্রণা দিয়ে গেলেন সুশান্ত

‘ছিছোরে’ (Chhicchore) ছবিতে অভিমানী প্রেমিকার মন গলাতে, প্রেমিকের কাতর অনুনয়, ‘ তুমহারি তাসবির কি সাহারে…. মৌসমী না সামঝো, ইশক কো হামারে..’ বুকে বেঁধেনি এমন মানুষ নেই। সেই প্রেমিক অনিরুদ্ধের চরিত্রটি করেছিলেন সুশান্ত সিং রাজপুত (Sushant Singh Rajput)। আজ তাঁর না থাকার দু বছর সম্পূর্ন হল, তবুও তাঁর প্রতি তাঁর অগনিত অনুগামির আবেগ, অনিরুদ্ধর সেই কাতর মিনতির মতোই। নিয়তির পরিহাসে, অনিরুদ্ধর স্থান নিয়েছেন আজ তাঁর অনুগামীরা, এবং সেই প্রেমিকার স্থানে স্বয়ং সুশান্ত।

১৪ জুন ২০২০, এক বিষন্ন, অভিশপ্ত দিনের প্রতিনিধি এই তারিখ। বান্দ্রার ফ্ল্যাটে পাওয়া যায় সুশান্তের নিথর দেহ। সেই সঙ্গে মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে ওঠে ভারতবাসীর হৃৎ-স্পন্দন। করোনাকালীন আবহে এমন হেন দুর্যোগের জন্য, কখনোই প্রস্তুত ছিলেন না কেউ। প্রাথমিক তদন্তে এলো, অবসাদ গ্রাস করেছিল বছর চৌত্রিশের সুশান্তকে। কিন্তু তাঁর মত জীবনের উদযাপন করা ব্যক্তিত্বের এ হেন পরিণতি, বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি তাঁর অনুগামীদের কাছে। তারপর একে একে কাটাছেঁড়া, জলঘোলা করে পরিস্থিতি জটিল হতে থাকে। বলিউডে পারিপার্শ্বিকতার চাপানউতোরে জড়িয়ে পড়েন সুশান্তের প্রেমিকা, অভিনেত্রী রিয়া চক্রবর্তীও (Rhea Chakraborty)।

সুশান্ত, এক স্ফুলিঙ্গের নাম। ক্ষণকালের ছন্দ পেয়ে যে এসে মানুষের মন জয় করে, সময়ের আগেই ফুরিয়ে গেলো। রেখে গেল কেবল একরাশ অভাববোধ। ১৯৮৬ সালের ২১ জানুয়ারি, পাটনায় জন্ম হয় সুশান্তের। শৈশব থেকেই পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি টান তৈরি হয় মেধাবী সুশান্তের। জাতীয় অলিম্পিয়াড বিজয়ীও হন তিনি। সাফল্য-মুখরিত শৈশবের মাঝেই, আকস্মিক জীবনের সেই তীব্র যন্ত্রণাটির সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে। ২০০২ এ মাতৃহারা হন সুশান্ত।

নাচের প্রতিও বেশ সক্রিয় প্রবণতা ছিল তাঁর। দিল্লী কলেজ অফ ইঞ্জিনীয়ারিং-এ পড়াকালীন, শ্যামক দাবরের নৃত্যদলে যোগদান করেন। তারই সঙ্গে গড়ে ওঠে তাঁর অভিনয়ের প্রতি উৎসাহ। পরিচালক বেরী জনের নাট্যগোষ্ঠীতে যোগদান করে পৌঁছে যান রুপোলি দুনিয়ার দোরগোড়ায়।

২০০৮ সালে একতা কাপুর (Ekta Kapoor) প্রযোজিত, বালাজি টেলিফিল্মসের (Balaji Telefilms) অধীনে ‘কিস দেশ মে হ্যায় মেরা দিল’ (Kis Desh Mein Hai Meraa Dil) ধারাবাহিক দিয়ে তাঁর হাতেখড়ি হয়। ২০০৯ এ ‘পবিত্র রিস্তা’ (Pavitra Rishta) ধারাবাহিকটির মাধ্যমে আসে সুশান্তের খ্যাতি। তারপর একে একে তাঁর রাজমুকুটে, নতুন নতুন পালকের সংযোজন ঘটতে থাকে। তিন বন্ধুকে নিয়ে তৈরি ‘কাই পো চে’ দিয়ে সুশান্তের বলিউডে আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর একের পর এক সংগ্রামের সোপান পেরিয়ে সাফল্যের বহুতলে ওঠা। ‘শুধ দেশী রোমান্স’, ‘পিকে’, ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সি’, ‘কেদারনাথ’, ‘রাবতা’র মত জনপ্রিয় ছবিতে তাঁর ভান্ডার ভরে ওঠে।

মহেন্দ্র সিং ধোনির আত্মজীবনী, ‘ এম.এস. ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ (M.S. Dhoni: The Untold Story) তে সুশান্তের অভিনয়, সারা ভারতবাসীর চোখে জল আনে। ধোনির হাব ভাব, আচার আচরণের প্রতিটি সূক্ষ্ম ভঙ্গি ধরা পড়ে সুশান্তের মধ্যে।

সুশান্তের মৃত্যুর আগে, ‘ছিছোরে’ ছবিটিও বিশেষভাবে হৃদয়স্পর্শী হয়। খুব আইরণিক্যালি সুশান্ত, জীবনের কাছে সহজে হার মেনে যাওয়া এক সন্তানের পিতার চরিত্রে অভিনয় করেন। যেখানে ছবির পরতে পরতে তাঁকে জীবনকে উপভোগ করতে থাকার সংলাপ শোনা যায়।

সুশান্তের মৃত্যুর পর ‘দিল বেচারা’ (Dil Bechara) ছবিটি মুক্তি পায়। যেটি ছিল সুশান্তের শেষ কাজ। এখানেও সুশান্তকে বলতে শোনা যায়, নতুন তারকারা আজকাল উদ্বায়ী হন, কেউ জীবনকে উপভোগ করেন না, বরং এদিক থেকে ওদিক হলেই নিজেকে শেষ করে ফেলার পথ বেছে নেন!

সুশান্তের শেষদিকের ছবিগুলি যেন, জীবনের কাছে হার মেনে যাওয়া সুশান্তেরই বিদ্রুপকারী! যে অনিরুদ্ধ বা ম্যানি (‘দিল বেচারা’ এ সুশান্ত অভিনীত চরিত্র) বারবার জীবনকে উপভোগ করতে বলল, সেই সুশান্তই কী করে জীবনের এমন সিদ্ধান্ত বেছে নিলেন! সুশান্ত তাঁর যে না থাকার ক্ষতটি তৈরি করে গেলেন, এক বহু সংখ্যক মানুষ সেই অভাবকে আঁকড়ে ধরেই তাঁর অস্তিত্ব অনুভব করে থাকেন। তাঁদের কাছে সুশান্তের এই ‘উপস্থিতি’ই হয়ে ওঠে, ‘কুছ তো হে তুঝসে রাবতা’!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *