টাইটানিক সম্পর্কে অবগত নন, এমন মানুষ হয়ত নেই। জেমস ক্যামেরুন পরিচালিত ১৯৯৭ সালে তৈরি হওয়া টাইটানিক চলচ্চিত্র, আপামর বিশ্ববাসীর মনে এক চিরন্তন বিষাদের ছাপ ফেলে গেছে। ঘটনাটি নির্মাতার মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল না। একটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল এই ছবি। আজকে সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনাগ্রস্ত টাইটানিক জাহাজটির সম্পর্কে, আপনাদের এমন কিছু তথ্য দেব যা শুনলে আপনারা রোমাঞ্চিত এবং শিহরিত হবেনই।
তো চলুন বন্ধুরা, আর দেরি না করে রওনা দেওয়া যায় টাইটানিক সফরে।
১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সেই অভিশপ্ত দিন। মাত্র আড়াই ঘন্টার মধ্যেই প্রথম সমুদ্র ভ্রমণে চিরতরে সলিল সমাধি ঘটে পৃথিবীর এই অন্যতম বিখ্যাত বিলাসবহুল জাহাজটির। প্রাণ হারান প্রায় পনেরোশোর অধিক যাত্রী। কেটে গেছে ঘটনাটির প্রায় শতাধিক বছর। তবুও টাইটানিক নিয়ে বিশ্ববাসীর কল্পনা জল্পনা বা উৎসাহর মধ্যে কোনরকম পূর্ণচ্ছেদ পড়েনি। বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে টাইটানিক নিয়ে নতুন তথ্যের সম্মেলন।
১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল, ব্রিটিশ যাত্রী নিয়ে, ব্রিটেন থেকে আটলান্টিক পেরিয়ে আমেরিকার উদ্যেশ্যে পাড়ি দেওয়ার কথা ছিল টাইটানিকের। ৮২২ ফুট ৯ ইঞ্চি লম্বা এই বিশালাকার জাহাজটি বানাতে সময় লেগেছিল প্রায় আড়াই বছর। তবে এটি অবাক হওয়ার কিছু নয়, তখনকার দিনে প্রায় সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি যাত্রীবাহী জলযান নির্মাণ করা একেবারেই ছেলের হাতের মোয়া ছিল না। প্রবল কসরত করতে হতো। দিনরাত এক করে শ্রমিকদের নিযুক্ত থাকতে হতো, মালিক শ্রেণীর মানুষের আরাম বিলাস প্রদানের জন্য। অবাককর বিষয়, জাহাজটিতে মোট আটখানি ডেক ছিল। জাহাজটির নির্মাণকার্য সরঞ্জামেরও ছিল মাত্র অতিরিক্ত প্রাচুর্য। তিরিশ লাখ লোহা এবং স্টিলের কাঠামো ব্যবহার করা হয়েছিল জাহাজটি তৈরির ক্ষেত্রে। বলা বাহুল্য, জাহাজটির সাজসরঞ্জামের প্রতিটি পদক্ষেপই কারিকরদের নিজের হাতেই প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। যে সকল স্টিলের গজাল গুলি টাইটানিকের নির্মানের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছিল তার সামগ্রিক ওজন ছিল বারোশো টনেরও বেশি। ১৯০৭ সালে এই দানবীয় টাইটানিক জাহাজটির নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। পাঁচ বছর একটানা নির্মাণকার্যের পর, অবশেষে ১৯১২ সালে জাহাজটি তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়। প্রসঙ্গত, নেদারল্যান্ডের ‘হোয়াইট স্টার লাইন’ এই জাহাজটির নির্মাণের দায়িত্বে ছিল। এটিকে সমুদ্রে ভাসমান করানো প্রথম দিকে সহজ না হলেও, জাহাজের চারপাশের যে উঁচু মাচান তৈরি করা হয়েছিল তা অপসারণ করা হয়। তারপর সেই অসমাপ্ত অবস্থায় জাহাজটিকে পাঠানো হয় হাইড্রোলিক রিভারে। এই দানবাকৃতি জাহাজকে তবুও দাঁড় করানো সহজ হচ্ছিল না। উপায় বেড় করা হয়। জাহাজটিকে দাঁড় করানোর সময় তার নিচ থেকে সকল কাঠামো সরিয়ে, কাঁচের রেলপথের মত একটি রাস্তা তৈরি করে, জাহাজটিকে চালনা করা হয় সমুদ্রে অবতরণের জন্য। বলা বাহুল্য, বিশালাকার জাহাজটির অবতরণকে আরও মসৃণ করে তোলার জন্য, রাস্তাজুড়ে তেল ঢেলে পিচ্ছিল করে তোলা হয়। তেইশ টন ডিজেল, মাছের তেল, এবং তরল সাবান ব্যবহার করে সেই তৈলাক্ত পথে টাইটানিককে সমুদ্রে প্রথম অবতরণ করা হয়।
টাইটানিক শুধু আকৃতিতে বিশাল ছিলনা নিরাপত্তার দিক দিও টাইটানিকের নির্মাণে কোন কমতি ছিল না। দুই স্তর বিশিষ্ট তলা তৈরি করা হয়েছিল, এবং এর হাল ষোলটি জল নিরোধক কম্পার্টমেন্ট দিয়ে আলাদা করা হয়। এছাড়াও আড়াআড়ি ভাবে পনেরোটি বাল্কহেড নির্মাণ করা হয়। এই বাল্কহেডগুলি এমন ভাবে তৈরি করা হয় যাতে জাহাজটির কোন অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক ক্ষতি না হয়। কম্পার্টমেন্টের দরজা নির্মাণেও টাইটানিকের নির্মাতারা কার্পণ্য করেননি। এয়ারটাইট দরজা নির্মাণ করে তাঁরা দক্ষ কারিগরি চিন্তা ভাবনার পরিচয়েই দিয়েছিলেন। টাইটানিককে ‘আনসিংকেবেল’ অর্থাৎ কখনও ডুবে যাবেনা এমন জাহাজ হিসেবেই কারিগর শ্রেণী প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি এক ট্র্যাজিক সমাপ্তির প্রতিনিধি হিসেবেই পরিচয় বহন করে চলে যেতে হচ্ছে টাইটানিককে। যা খুবই দুঃখজনক।
শুনলে অবাক হবেন, অনেক গবেষক মনে করেন টাইটানিকের এই করুন পরিণতির পেছনে আছে দূরবীনের ব্যবহার না করা। হ্যাঁ বন্ধুরা, ঠিকই শুনছেন। জাহাজে দূরবীন থাকলেও একটি হাস্যকর ভুলের কারণে দূরবীন ব্যবহারের কথা কারুর মনে আসেনি। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, দূরবীনের দায়িত্বে ছিলেন ডেভিড ব্লেয়ার নামে এক ব্যক্তি, যিনি ছিলেন ক্রু এর সদস্য। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁর কোনও এক বুকের জন্য তাঁকে কাজ থেকে বরখাস্ত করা হয়, এবং তিনি জাহাজ থেকে ৯ এপ্রিল পদচ্যুত হন। এবং ভুল করে দূরবীন রাখার লকারের চাবি তিনি তাঁর সঙ্গেই নিয়ে চলে যান, জাহাজে না ফেরত রেখে। আবার অনেকে বলেন দূরবীনগুলি ছিল তাঁর কেবিনেই। যা তিনি জাহাজ ছাড়ার সময় নিয়ে চলে যান। গবেষকদের মতে দূরবীন না থাকা টাইটানিকের করুন পরিণতিকে ত্বরান্বিত করার অন্যতম মূল অনুঘটক ছিল।