“তালি, বাজাউঙ্গী নেহি..বাজবাউঙ্গী..!” বছর ষোলো সতেরোর গনু, ওরফে গণেশ সাওয়ান্ত। স্কুলে শিক্ষিকার প্রশ্নের উত্তরে জানায়, বড় হয়ে সে ‘মা’ হতে চায়। মুহূর্তে বিদ্রুপের হাসিতে ফালা ফালা হয়ে যেতে থাকে গণেশের এই স্বপ্নালু উপলব্ধি। সমাজের কাছে প্রথম ধাক্কা খায় গনু। কবি-গুরুর কথাই ধার করে বলতে হয়, গনু বুঝতে পারে, “এ জগৎ স্বপ্ন নয়..”। গনু যে জন্মগত ভাবে ‘পুরুষ’! অথচ জীবন সে নারীর লাভ করতে চায়! সব মাছের থেকে ‘আলাদা’ বলেই গোল্ড ফিস আমাদের প্রিয় হতে পারে, কিন্তু তথাকথিত ভাবে সমাজ প্রদত্ত জেন্ডার আইডেন্টিটি থেকে আলাদা হলে..? সমাজের বাঁকা নজর হয়ে ওঠে ভবিতব্য! হতে হয় ‘বহিষ্কৃত’!
‘তালি’, সুস্মিতা সেন অভিনীত জিও সিনেমায় সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সিরিজটি একজন নাগরিক হিসেবে দাঁড় করিয়েছে প্রশ্নের মুখে। শ্রীগৌরী সাওয়ান্তের পথ চলা হয়ে উঠেছে এই সিরিজের উপজীব্য। গৌরী, কোনও সাধারণ মানবী নন! জন্ম হয়েছিল তাঁর পুরুষ শরীরে। গণেশ সাওয়ান্ত, অর্থাৎ গনু হিসেবেই মধ্যমণি ছিলেন পরিবারের। মায়ের শাড়ি, নেলপালিশ, লিপস্টিকই ছিল তাঁর বয়ঃসন্ধির সঙ্গী। কিন্তু সমাজের কাছে যে তা নীতি বিরুদ্ধ! আর এই বৈপরীত্যের সূত্রপাত ঘটে, নিজের পরিবার থেকেই। ‘মেয়েলি’ স্বভাবের গণেশকে গ্রহণ করতে পারেননি তাঁর বাবা, ফলে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয় বছর আঠারোর যুবককে। সমাজের বিধান অনুযায়ী, সমাজের ‘বাইরে’ হয়ে ওঠা একজন মানুষ থেকে, সমাজের অন্তভূর্ক্ত হতে চাওয়া মানুষে পরিণত হওয়ার জন্য শুরু হয় গণেশের, গৌরী হয়ে ওঠার সংগ্রাম।
গণেশ গৌরী হতে পেরেছিল। শুধু গৌরীই নয়, গণেশ তাঁর শৈশবের মনস্কামনা অনুযায়ী ‘মা’ হতেও পেরেছিল। সমাজ তাঁকে চেয়েছে দমিয়ে রাখতে, চেয়েছে কালিমালিপ্ত করতে। কিন্তু শেষমেশ সুপ্রিম কোর্টের রায় তাঁর কালিমালিপ্ত অস্তিত্বকে শোধন করে তুলতে অগ্রসর হয়েছে। গৌরী পেরেছে। গৌরী পেরেছে স্বভিমান এবং স্বতন্ত্রতার লড়াইয়ে জিততে। গৌরী পেরেছে ‘ইকুয়ালিটি’ আনতে। ফর্ম ফিলাপ হোক বা শৌচালয়, পুরুষ এবং নারীর সঙ্গে ‘Others’ এর অপশন গৌরীর লড়াই দ্বারা যুক্ত হতে পেরেছে। কুর্নিশ, কুর্নিশ জানাই ‘গৌরী আম্মা’!
সুস্মিতা সেন এই চরিত্রে অভাবনীয় দক্ষতা দেখিয়েছেন। প্রমাণ করেছেন তিনি জাত শিল্পী। গৌরীর মত তিনিও তালি না বাজিয়ে, দর্শকের করতালির কারণ হয়ে উঠেছেন। রবি যাদব পরিচালিত এই সিরিজটি জুড়ে কেবল যেন প্রতিফলিত হয়েছে সমাজের এক সংকীর্ণ মনস্তত্ত্বের প্রতিচ্ছবি। যেখানে দেখা গেছে সমাজের তথাকথিত ‘সু-নাগরিক’দের মানসিক অপরাগতা। দর্শকদের হিসেবে এই সিরিজকে সকলেই গ্রহণ করেছেন এবং পরিপূর্ণতা দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, বাস্তব জীবনে কতটা প্রভাব ফেলবে গৌরীর মত মানুষদের সংগ্রাম? আমরা সু-দর্শক হয়ে উঠতে পেরেছি, কিন্তু সু-নাগরিক কি হয়ে উঠতে পেরেছি?