“পিয়া তোরা, কেয়সা অভিমান..?” আজ থেকে দশ বছর আগে, এমনই এক বৃষ্টির তারিখে, তিনি মন খারাপের দিস্তা গুছিয়ে এক অজানা ‘অসুখ’ এর নামে হারিয়ে গেলেন চিরতরে। ঋতুপর্ণ ঘোষ (Rituparno Ghosh), কেটে গেছে ‘ঋতু’হীন দশটি বছর। তাঁর সৃষ্টির প্রসঙ্গে বলতে গেলেই প্রথমে বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করেই যেন ঋতুপর্ণ হয়ে ওঠেন বাঙালির প্রাণের ‘দোসর’। তাঁর ছবিতে বারবার উঠে এসেছে রবীন্দ্র-চেতনা। রবীন্দ্রনাথের মতই নারী হয়ে উঠেছেন, ঋতুপর্ণের ছবির ‘নায়ক’। কখনও বা কাটা ছেঁড়া করেছেন সম্পর্ক নিয়ে। আজকের এই বিশেষ দিনে, ঋতু স্মরণে থাকল, তাঁরই সৃষ্টির কিছু বৈশিষ্ট্য।
সবচেয়ে বড় রবীন্দ্র প্রভাব ঋতুপর্ণের ছবিতে লক্ষ্য করা যায়, নারী চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির মতই, ঋতুপর্ণের নারীরাও কেউ তথাকথিত সমাজ-আরোপিত গুণে সিদ্ধ নন। তাঁরা নিজের মত, স্বতন্ত্র। ১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘উনিশে এপ্রিল’ (Unishe April) ছবিটি যেমন ছিল নারীকেন্দ্রিক। অপর্ণা সেন (Aparna Sen) অভিনীত ‘সরোজিনী’ চরিত্রটি সমাজের চোখে এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। যিনি অবলীলায় তাঁর মৃত স্বামীর মৃত্যুর দিন ভুলে যেতে পারেন, এমনকী সন্তানকেও মানসিক ভাবে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন তাঁর নিজের কর্মক্ষেত্রের জন্য। স্বামী-সন্তান ব্যতীতও যে কোনও নারীর ব্যাক্তিগত জীবন থাকতে পারে, ঋতুপর্ণ সেই ধারণারই দৃশ্যায়ন ঘটান সরোজিনীর মাধ্যমে। মেয়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে পাহাড় প্রমাণ মানসিক দূরত্ব। কিন্তু শেষে গিয়ে স্বামীর প্রতি বা সন্তানের প্রতি এই ‘ঔদাস্য’র কারণও স্পষ্ট হয়। বিবাহের পর অন্যান্য বিবাহিতা স্ত্রীর মতই সরোজিনীকে তাঁর স্বপ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য করেন তাঁর স্বামী। কারণ সমাজ বলে দিয়েছে, সংসারিক ঘেরাটোপই যে একজন বিবাহিতা নারীর জীবনের সত্যি। সরোজিনী সেই ঘেরাটোপ ছিন্ন করতে চান, নিজের স্বপ্নে বাঁচতে চেয়ে, হয়ে ওঠেন আপন সন্তানের চোখেই ‘ভিলেন’। ঋতুপর্ণ এখানেই ব্যতিক্রম আনেন। নারী মানেই ভালো স্ত্রী, অথবা ভালো মা হয়ে ওঠার জন্য নিজস্ব শখ, আহ্লাদ, ইচ্ছেকে যে বিসর্জন দেওয়া, তা কোনওমতেই নয়। নারী সবার আগে একজন মানুষ, তারপর তিনি নারী।
মা মেয়ের এমন সমাজ বিরুদ্ধ রসায়ন পাওয়া গেছে, ‘তিতলি’ (Titli) ছবিতে। মায়ের প্রাক্তন প্রেমিককে, ভালোবেসে ফেলেছেন মেয়েও। মায়ের সঙ্গে চলে মেয়ের মনস্তাত্বিক দ্বৈরথ। মায়ের মধ্যেও যে এক অপূর্ন প্রেমিকা সত্তা বেঁচে আছে, বয়সের সীমাকে তুচ্ছ রেখে তাঁরও যে প্রেম কাম্য, এ কথা মেয়ের স্বীকার করতে সময় লাগে। শুধু মেয়েরই নয়, সমাজের এমন নারী চরিত্রকে স্বীকার করতে যথেষ্ট সময় লাগে। আর এখানেই ঋতুপর্ণের সার্থকতা, এখানেই তাঁর রবীন্দ্র-সাধনার সার্থকতা। তথাকথিত মমতাময়ী, স্নেহময়ী মায়ের আঁচল সরিয়েও যে, একজন রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে মা’কে প্রতিষ্ঠা করা, যাঁর মধ্যে ষড়রিপু বর্তমান থাকা স্বাভাবিক, সেখানেই ঋতুপর্ণ ভাঙনের জয়গান গেয়েছেন।
ঋতুপর্ণের আরও একটি তথাকথিত সমাজ-বিমুখ সৃষ্টি হল ‘চিত্রাঙ্গদা’ (Chitrangada) । মনিপুর রাজকুমারীর যে সত্যতা রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছিলেন তাঁর সাহিত্যকর্মে, ঋতুপর্ণ রুপোলি ক্যানভাসে তাকে আরও জীবন্ত করে তুলেছিলেন। তাঁর নির্মিত ‘চিত্রাঙ্গদা’ তথাকথিত আধুনিক সমাজের হলেও, তাঁকে গ্রহণ করবার মানসিকতা এখনও তৈরি হয়নি। স্বয়ং ঋতুপর্ণ নামভূমিকায় অভিনয় করেন এই ছবিতে। এটি যেন তাঁরই আত্মকথন। তাঁর চরিত্রের নাম হয় রুদ্র। শারীরিক ভাবে পুরুষ শরীরের অধিকারী হলেও, মননশীলতায় রুদ্র একজন নারী। তাঁর প্রেমিক একজন পুরুষ। সংসার করে, সন্তান দত্তক নেবেন এমনই অভিপ্রায় ছিল এই সমলৈঙ্গিক যুগলের। ছবির মাধ্যমে ঋতুপর্ণ ভাঙতে চেয়েছিলেন সামাজিক ‘স্টিরিওটাইপ’। ভালোবাসা যে সত্যিই স্থান, কাল, পাত্রের ঘেরাটোপের অধীন নয়, তা আক্ষরিক অর্থে সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠা করবার আগেই থেমে যায় শিল্পী ঋতুপর্ণের তুলির টান।
আজ, ৩০ মে ২০২৩। দশটি বছর কেটে গেল, কিন্তু ‘হীরের আংটি’ আর খুঁজে পাওয়া গেল না। বাঙালি যত না সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছেন, একজন ঋতুপর্ণ ছিলেন বলে রবীন্দ্রনাথকে আরও আত্মিক ভাবে গ্রহন করেছেন। ঋতুপর্ণ যেন এক ‘উৎসব’ এ মাতিয়ে রেখেছিলেন বাঙালি সিনেপ্রেমীদের, যার রেশ চির ‘আবহমান’।