‘হোলিকা দহন’ থেকে রাধা-কৃষ্ণ লীলা, দোল নিয়ে কথিত পুরাণের কাহিনী, জানেন কি?

‘আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বলো হরি বোল…’ ছোটবেলা থেকে দোলের আগের দিন এই রীতিটা আমরা কম বেশি সবাই পালন করে থাকি। আজকের রাত পোহালেই রঙের উৎসবে মেতে উঠবেন বাঙালি। কিন্তু পুরাণে এই রঙের উৎসব নিয়ে কোন কোন গল্প কথিত আছে, জানেন কী? চিন্তা নেই, আজকের বিশেষ পর্বে আপনাদের জন্য রইল পুরাণের দোল-চরিত।

পুরাণে দোল বা হোলির উল্লেখ বেশ প্রকট। বিশেষত শ্রীকৃষ্ণকথায় বারবার উঠে এসেছে এই রাঙিয়ে দিয়ে যাওয়ার উৎসবের কথা। সপ্তম শতকে রচিত শ্রীকৃষ্ণের ‘রত্নাবলী’ হোক বা জীমূতবাহনের ‘কালবিবেক’, এমনকী ষোড়শ শতকের ‘রঘুনন্দন’ গ্রন্থেও খোঁজ পাওয়া গেছে এই উৎসবের।

স্কন্ধ পুরাণের ফাল্গুন মাহাত্ম্য গ্রন্থাংশে রয়েছে স্বৈরাচারী রাজা, হিরন্যকশিপুর পতনের কাহিনী। তিনি অমরত্মের বর লাভ করেন। সেই বর অনুযায়ী কোনও মানুষ বা পশু তাঁকে হত্যা করতে পারবে না। এমনকী দিনে বা রাতে, এবং ঘরের মধ্যে বা স্থলে এবং জলেও হবে না তাঁর মৃত্যু। অমরত্মের এই বরে যারপরনাই খুশি হয়ে উঠলেন রাজা হিরন্যকশিপু। বলা বাহুল্য, অধিক উৎসাহে তিনি অহংকারী হয়ে পড়েন। নিজেকে দেবতুল্য ভাবতে শুরু করেন এবং ভয়ে দিয়ে জয় করতে চান মানুষের সেবা। তাঁর এই দুর্নীতিতে সায় দেয়নি তাঁর হরিভক্ত পুত্র প্রহ্লাদ। ফলে বাঁধে পিতা পুত্রের বিরোধ। হিরন্যকশিপুর আত্ম অহংকারের পরিমাণ এত প্রকট হয়ে ওঠে যে তিনি নিজের পুত্রের হত্যার ছক কষেন। তাঁর সঙ্গী হন তাঁর ভগিনী হোলিকা। তিনি অগ্নির বর প্রাপ্ত ছিলেন। বর অনুযায়ী, অগ্নি দ্বারা তিনি কখনও মৃত্যুবরণ করবেন না। হিরন্যকশিপু ঠিক করলেন, হোলিকার কোলে থাকবে প্রহ্লাদ, এবং বিধ্বংসী অগ্নিতে দগ্ধে যাবে ছোট্ট শিশুর দেহ। অভিসন্ধি মত, প্রহ্লাদসহ হোলিকার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন হিরন্যকশিপু। বিষ্ণুভক্ত ছোট্ট প্রহ্লাদ অগ্নিতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে করতে থাকে আরাধ্যের নামে জপ। হোলিকার এই কুকর্মের ফল স্বরূপ মৃত্যু হয় তাঁর। অগ্নি প্রদত্ত বরকে অপব্যাবহার করায় চরম পরিণতি নেমে আসে তাঁর জীবনে। বেঁচে যায় ছোট্ট হরিভক্ত প্রহ্লাদ।

বোনের মৃত্যুতে রাগে, ক্ষোভে আরও জর্জরিত হয়ে ওঠেন অত্যাচারী হিরন্যকশিপু। নিজ হস্তে পুত্রকে হত্যা করতে উদ্যত হন তিনি। কিন্তু বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদকে এবার স্বয়ং বিষ্ণু এসে উদ্ধার করেন। নরসিংহ অবতারের আবির্ভূত হন তিনি। অর্থাৎ না মানুষ, না পশু। সময়? গোধূলি লগ্ন, অর্থাৎ না দিন না রাত। ঘরের মধ্যে নয়, ঘরের চৌকাঠে উড়ুর ওপর রেখে হিরন্যকশিপুর নাড়িভুঁড়ি বের করে দেন তাঁর থাবা দিয়ে। মৃত্যু হয় এক অশুভ শক্তির। এই ঘটনাটি ঘটে ফাল্গুনী পূর্ণিমার ঠিক আগের দিন।

অশুভ শক্তির আধার ঘুচে, যে শুভ শক্তির সূচনা হল, তার কারণেই দোলের আগের দিন ‘হোলিকা দহন’ অর্থাৎ ‘নেড়াপোড়া’ উৎসব পালন করে থাকেন হিন্দু জাতি।

আরও একটি কৃষ্ণকথায় জানা যায়, অত্যাচারী মথুরা-রাজ কংস, তাঁর জীবনের ‘কাল’ শ্রীকৃষ্ণকে হত্যা করার জন্য, পুতনা রাক্ষসীকে কৃষ্ণের কাছে পাঠান। দৈব শিশু কৃষ্ণ, মামা কংসের চাল বুঝতে পেরে পূতনা রাক্ষুসীর স্তনে দংশন করেন। ফলে মৃত্যু হয় ছলনাময়ী এই দানবীর। হোলিকার মত, হিন্দুদের মধ্যে পূতনা দহণেরও প্রচলন আছে দোলের আগের দিন।

অন্য এক কাহিনী অনুযায়ী, ভারতের ব্রজ অঞ্চলে বেড়ে উঠেছিলেন নন্দদুলাল শ্রীকৃষ্ণ। কোন এক সুমধুর বসন্তের পঞ্চম দিনেই, তাঁর সঙ্গে তাঁর পরম সখী শ্রীরাধিকার এক স্বর্গীয় মিলন রচিত হয়। সেই স্মৃতি হিসেবেই দিনটিকে রঙিন হিসেবে স্মরণ করার জন্য দোল উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে।

দোল নিয়ে কৃষ্ণকথার আরও একটি উল্লেখযোগ্য কাহিনী হল, যৌবনে শ্যাম বর্ন হওয়ার দরুন, গৌড় বর্না রাধার সম্মুখীন হতে কৃষ্ণ মুষড়ে পড়েন। তাঁর হতাশা ঠাওর করতে পেরে মা যশোদা তাঁকে আবীরের রঙে ভরিয়ে দেন, এবং বলেন তাঁর গায়ের আবীর রাধাকেও ছুঁয়ে দিতে। এর ফলে কৃষ্ণ আর রাধার মধ্যে আর কোনও তফাৎই রইল না। দুজনেই সম প্রেমের রঙে মত্ত হয়ে উঠলেন।

কিন্তু রাধা কৃষ্ণকে নিয়ে সবচেয়ে চর্চিত কাহিনীটি বলা, এখনও বাকি রয়েছে। বৃন্দাবনে প্রিয় সখী-সঙ্গে রাধা ক্রীড়ায় মত্ত ছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন কৃষ্ণও। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত রাধা, ঋতুমতী হয়ে পড়েন। প্রাণের প্রিয় সখীকে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে, কৃষ্ণ তাঁর দিকে আবীর ছুঁড়ে দেন। মুহূর্তে আবীরের রঙে মেতে ওঠে সমগ্র বৃন্দাবনবাসী।

Scroll to Top