উত্তরপ্রদেশের মুজাফফার নগরের বুধানা গ্রামে, নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে, ১৯৭৪ সালের ১৯ মে জন্ম হয় ছেলেটির। পরিবারের নয়জন কনিষ্ঠের মধ্যে তিনিই সর্বজ্যেষ্ঠ। সেই গ্রামের ভিত মাত্রই ছিল, আখ, গম এবং বন্দুক! তবু সেই ছেলেটির চোখে ছিল, এক অন্য পৃথিবীর স্বপ্ন। সে দেখতো, সে এইসব কিছু থেকে বেরিয়ে, নিজের জগৎ তৈরি করবে! সেই জগতে সে তাঁর স্বপ্ন রঙে বাস্তবের জমিতে প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই স্বপ্ন, আসলে তাঁর দূরদৃষ্টি ছিল! সেই ছোট্ট ছেলেটি, আজ ৪৮ বছরে পদার্পণ করলো! তিনি হলেন, আজকের বলিউডের ‘চাঁদ নবাব’ নওয়াজউদ্দীন সিদ্দিকী (Nawazuddin Siddiqui)।
তাঁর জীবনের গল্পটা, সেই পাতালপুরীর রুপোর কাঠির ছোঁয়ায় ঘুমিয়ে থাকা রাজকন্যার মত। যদিও কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তির দ্বারা সোনার কাঠি নওয়াজকে ছোঁয়াতে হয়নি, তাঁর জীবনের সোনার কাঠি তিনি নিজেই! অক্লান্ত পরিশ্রম, কঠোর অধ্যবসায়, হার না মানা, জেদ নিয়ে তৈরি হয়ে উঠেছিল বুধানার সিদ্দিকী পরিবারের বড় ছেলেটি। গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষাটুকুরও চলনসই বন্দোবস্ত ছিলনা। তবুও এই অদম্য ইচ্ছাশক্তির অধিকারী ছেলেটি, তাঁর গ্রাম এবং আশেপাশের গ্রামের মধ্যে প্রথম কেমিস্ট্রি গ্রাজুয়েট হন। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে, কেমিস্ট হিসেবেও যোগ দেন তিনি। কিন্তু কথায় বলে নাহ্, মানুষ আর ভাগ্য, দুইয়ের লিখন কখনোই সাম্যতা বজায় রাখেনা। নওয়াজ যা চাননি, ভাগ্য সেদিকেই তাঁকে আগ্রহী করে তোলে। পাড়ি দেন রাজধানী দিল্লীতে। সেখানে তাঁকে প্রভাবিত করে মঞ্চাভিনয়। নওয়াজ এবার, তাঁর ভেতরের অভিনয়-পিপাসু সত্তাটির অনুসন্ধানে সফল হন। মঞ্চে কাজ করা শুরু করেন। কিন্তু অভিনয়ের নয়, মঞ্চকর্মী হিসেবে। এমনকি, মঞ্চে প্রহরীর কাজও তাঁকে করতে হয়েছিল তাঁর দৈনন্দিন যাপনের খরচ সামাল দিতে।
এক দেড় বছর এমন দুঃসহ পরিস্থিতিতে থাকার পর, নওয়াজ ভর্তি হলেন ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামাতে (National School Of Drama)। ১৯৯৬ সালে এই সফর শেষ করে, নওয়াজ পাড়ি দিলেন, স্বপ্ন-নগরী মুম্বইয়ে। এক আকাশ স্বপ্ন চোখে নওয়াজ ফের নাটকের দলে যুক্ত হতে গেলেন! কিন্তু ভাগ্য তখনও তাঁর সঙ্গ দিলনা। তার কারণ, নওয়াজের চেহারা! ছোটখাটো শরীর, কৃষ্ণকায়, শীর্ণ চেহারার ব্যক্তিত্ব, অভিনয় জগতে স্থান পায়না! আর সিনেমা! সেই মুহূর্তে নওয়াজের জীবনটা, ‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা’সম হয়ে উঠেছিল। তাঁর ভান্ডারে ছিলনা রূপ সৌন্দর্য, অথবা সম্ভ্রান্তশালী পারিবারিক ‘স্টাম্প’! অভিনয়ের আগে, যেগুলির কদরই হয় সর্বত্র। নওয়াজের ভান্ডারে, এক অভিনেতা নওয়াজের স্ফুলিঙ্গ উদীয়মান হচ্ছিল। কিন্তু প্রকাশের মত কোন পাত্র পাওয়া যাচ্ছিলনা। ততদিনে তিনি মঞ্চে ছোটখাটো চরিত্র, যেমন চোর, ভিক্ষুক, পকেটমার, মালী ইত্যাদিতে অভিনয় করতে শুরু করেছেন।
আস্তে আস্তে, নওয়াজ নামক জ্বলন্ত শিখাটির প্রকট হওয়ার সুযোগ পাওয়া যেতে লাগলো! নওয়াজের মঞ্চে অপ্রধান চরিত্রে অভিনয় দেখেই, তৎকালীন নবাগত পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ (Anurag Kashyap) তাঁর ছবি ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ (Black Friday) তে তাঁকে সুযোগ দিলেন, এবং একটি বড় চরিত্রেই নওয়াজকে কাস্ট করলেন। তুখোড় অভিনয়ে নওয়াজ তাঁর জাত চিনিয়ে দিলেও, অন্য কোনো পরিচালকের নজরে তিনি পড়লেন না। নওয়াজের জীবনে নেমে এলো হতাশা। এমনকি এই জগতের মায়া কাটিয়ে তিনি তাঁর গ্রামেও ফিরে ক্ষেতের কাজ করতে চেয়েছিলেন! কিন্তু ফিরে গেলে, ‘ব্যর্থ যোদ্ধা’ হিসেবে, গ্রামের মানুষ তাঁকে কটাক্ষ করবে! সেই কটাক্ষের বিমুখ হয়েই তিনি জেদ ধরলেন, তাঁকে টিকে এখানকেই থাকতে হবে! তাঁর এই কঠিন টালমাটালে আবার রক্ষাকবচ হলেন অনুরাগ। নওয়াজকে সুযোগ দিলেন ‘গ্যাংস অফ ওয়াশিপুর’ এ। সেখানে নওয়াজের চরিত্রের নাম হল ‘ফৈজল খান’, খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেও এই চরিত্রটি সিনেমা জগতের ইতিহাসে অন্যতম উজ্জ্বল উপস্থিতি। সিনেমাটি বক্স অফিসে সাফল্য পাওয়ার সঙ্গে, এবার নওয়াজের ভাগ্য-তরী স্রোতের অনুকূলে বইতে শুরু করলো। একের পর এক সাফল্যের সিঁড়িতে উঠতে থাকলেন তিনি। প্রচুর কাজের মাধ্যমে মন জয় করলেন আপামর ভারতবাসীর।
যদিও বলিউডে নওয়াজের হাতেখড়ি হয়, আমির খান (Amir Khan) অভিনীত ‘সারফারোস’ (Sarfarosh) ছবিতে। কিন্তু সেখানে একটি ছোট ভূমিকায় তাঁর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। রাজকুমার হিরানীর (Rajkumar Hirani) ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ (Munna Bhai M.B.B.S.) ছবিতেও তাঁকে পকেটমারের ভূমিকায় দেখা যায়।
বলিউডের ‘বাদশা’ শাহরুখ খান (Shah Rukh Khan) স্বয়ং, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নওয়াজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। তিনি এক প্রতিবেদনের সাক্ষাৎকারে জানান, সময়ের বা অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে হয়তো তিনি এগিয়ে, কিন্তু অভিনয়ের দিক দিয়ে নওয়াজ তাঁর চেয়েও এগিয়ে। কিং খানের মুখে এ হেন প্রশংসা, সকলের ভাগ্যে কড়া নাড়েনা।
২০১২ সালে ‘তালাশ’ (Talaash) এবং ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’ (Gangs of Wasseypur) এর জন্য নওয়াজের ঝুলিতে আটটি পুরস্কার সংগৃহীত হয়েছিল। যে ব্যক্তির শুরু ছিল শুন্য থেকে, তাঁর অদম্য জেদ, মানসিক শক্তি আজ তাঁকে উজাড় করে সফলতা দান করেছে। পরিশ্রমের সঙ্গে ত্যাগও তাঁকে অদ্বিতীয় করে তুলেছে।
নওয়াজ, ‘দ্য লাঞ্চবক্স (The Lunchbox)’, ‘মান্টো (Manto)’, ‘রমন রাঘব 2.0 ‘-এ (Raman Raghav 2.0) তার ভূমিকার জন্য সর্বাধিক চর্চিত হয়েছেন। তিনি দুটি এমি -মনোনীত সিরিজ, সেক্রেড গেমস (Sacred Games) এবং ব্রিটিশ ‘ম্যাকমাফিয়া’তে (McMafia) অভিনয় করেছেন । এছাড়াও সালমান খান (Salman Khan) অভিনীত ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ (Bajrangi Bhaijaan) ছবিতে তিনি ‘চাঁদ নবাব’ নামের এক প্রানবন্ত, সৎ সাংবাদিকের চরিত্রে অভিনয় করেন, যে চরিত্রটি সকল বয়সের মানুষের মনে নতুন করে বিশ্বাসের সঙ্গা প্রদান করে, নতুন করে মানুষকে ভরসা করার আশ্বাস পায়। চরিত্রটি যেন নওয়াজেরই আর একটি সত্তা!
সম্প্রতি তিনি মুম্বাইয়ে একটি প্রাসাদসম বাড়ি বানিয়েছেন। ছোটবেলার গ্রামে, শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত তাঁর বাড়িটিই, এখনকার তাঁর এই অট্টালিকার আদল। বাড়িটির নামকরণে রেখেছেন তাঁর বাবার উপস্থিতি। নাম। দিয়েছেন ‘নবাব’! নওয়াজ একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছিলেন তাঁর গ্রাম সম্পর্কে, সেখানে এখনো জাতপাত, ভেদাভেদকে শীর্ষে রাখা হয়। তাঁর ঠাকুমা নিম্নবর্গের মানুষ ছিলেন বলে, এখনও নওয়াজদের একঘরে করে রাখা হয়! তবুও, যতই পিছিয়ে থাকুক নাহ্ কেন উত্তরপ্রদেশের সেই ছোট্ট গ্রাম, শৈশবের স্মৃতি বহনের দিক দিয়ে সবসময় সেই গ্রাম নওয়াজের মানস সরোবরে থেকে যাবে।