যে সকল তারারা হারিয়ে গেলেন, অনেক তারার মাঝে! বছর শেষে ফিরে দেখা…

‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’ আর এই হল আমাদের জীবন স্রোত। বছর শেষে ঝড়া পাতার, আরও একবার উড়ে এসে নতুন বছরের আগাম বার্তা জানানোর সময় এসেই গেল। কিন্তু এও ভুলে গেলে চলবে না, নতুনের আগমন হয়, অনেক হারিয়ে ফেলা সময়ের বিনিময়। আর সেই সময়ের সঙ্গে থেকে যান, আমাদের কাছের মানুষও। চলতি বছর ধরে আমরা হারিয়েছি, এমন কিছু ব্যক্তিত্বকে, যাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই ভারতীয় সংস্কৃতি মহলের অন্যতম কান্ডারী। তাই এই বছরের শেষ লগ্নে, নতুন বছরের প্রাক্কালে সেই সকল তারাদের খোঁজা।

শাঁওলি মিত্র- ভারতীয় নাট্য ইতিহাসের অন্যতম পথিকৃৎ শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্রের কন্যা, শাঁওলি মিত্র এই যুগের সকল নাট্য গোষ্ঠীর অন্যতম অভিভাবক ছিলেন। শৈশবে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী নাটক ‘ডাকঘর’ এ অমলের ভূমিকায় অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়ে দেন। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম শুকতারা ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় ‘যুক্তি তক্ক আর গল্প’ তে তিনি বঙ্গবালার ভূমিকায় অভিনয় করেন। তাঁর দল ‘পঞ্চম বৈদিক’ , নাট্য প্রেমী মানুষদের বিভিন্ন নাটক যেমন ‘নাথবতী অনাথবত’, ‘একটি রাজনৈতিক হত্যা’ দ্বারা মন জয় করে। শাঁওলি মিত্র চলতি বছরের শুরুতে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ১৬ জানুয়ারি, মাত্র ৭৪ বছর বয়সে মৃত্যু হয় মঞ্চের ‘পাখি’ এই অভিনেত্রীর।

শাওলি মিত্র

নারায়ণ দেবনাথ – আমাদের শৈশবের স্রষ্টা ছিলেন তিনি। তাঁকে ছাড়া ছোটবেলা অসম্পূর্ণ। আমরা বড় হয়ে উঠেছিলাম ‘নন্টে ফন্টে’র দুষ্টু বুদ্ধি, এবং অন্যায়কারীদের শাস্তি দেওয়া ‘বাঁটুল দি গ্রেট’ এর সাহস ও শক্তি নিয়ে।তাঁদের সৃষ্টিকর্তা, নারায়ণ দেবনাথ। এই বছর আমাদের শৈশবকেও চোখে আঙুল দিয়ে হারিয়ে ফেলার বছর। চলতি বছর ১৮ জানুয়ারি, ৯৬ বছর বয়সে হাওড়ার বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, আমাদের শৈশবের সেই কারিগর। তাঁর মৃত্যুতে এক কঠিন জমিতে উপনীত হতে হয় কমিক্স-প্রেমীদের! আর ‘হ্যাপি এন্ডিং’ হল না শৈশবের এই কারিগরের জীবনের গল্পের। বরং যন্ত্রণা দিয়ে জিইয়ে রেখে গেলেন তাঁর সৃষ্টিকে।

নারায়ণ দেবনাথ

লতা মঙ্গেশকর- সঙ্গীত জগতেও নেমে এসেছে অমানিশা! ‘আসমান কে নীচে’ (Aasman Ke Neeche) আর থাকা হয়নি সুরের সম্রাজ্ঞীর। চলতি বছর ৬ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ অসুস্থতার পর পরলোক গমন করেন লতা মঙ্গেশকর। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।

লতা মঙ্গেশকর

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় – শঙ্খ জ্বালিয়ে ঘরের লক্ষ্মীকে ঘরে আনতে বলেও, তিনি আর ঘরে ফেরেননি। কলকাতার এক হাসপাতালে ১৫ ফেব্রুয়ারি জীবনাবসান হয় ‘গীতশ্রী’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয় ৯০। জীবনের শেষ বিন্দু পর্যন্ত তাঁর কেটেছে সঙ্গীতের আবহে। তাঁর ব্যক্তিগতবর্গের থেকে শোনা যায়, মৃত্যুর আগে তিনি শেষ শুনেছিলেন, প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী মান্না দের বিখ্যাত গান, ‘শহর থেকে আরও অনেক দূরে’। হয়ত একেই বলে নিয়তি!

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়

বাপ্পি লাহিড়ী – ভারতীয় সঙ্গীত জগতের আকাশে ১৫ ফেব্রুয়ারি আরও একটি অভিশপ্ত দিন। ‘ডিস্কো কিং’ বাপ্পি লাহিড়ী, চিরকাল গানের মাধ্যমে সকলের চিত্ত রঞ্জন করে গেছেন, কিন্তু তাঁর জীবনের শেষ মুহুর্তই হল মর্মান্তিক। মাত্র ৬৯ বছর বয়সে, ঘুমের মধ্যেই স্লিপ অ্যাপনিয়া হয়ে মৃত্য ঘটল তাঁর। তাঁর অনুগামীসহ সারা ভারতবাসী, তাঁর এই আকস্মিক মৃত্যুশোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েন।

বাপ্পি লাহিড়ি

অভিষেক চট্টোপাধ্যায়- একের পর এক সংস্কৃতি মহলে শোকের ছায়া নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই টলিউডেও একটি ভয়াবহ দুসংবাদের আবহ তৈরি হয়ে ওঠে। মাত্র ৫৭ বছর বয়সে শুটিং করতে করতেই অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন অভিনেতা অভিষেক চ্যাটার্জী। অভিনেতার মৃত্যু মানতে পারেননি তাঁর পরিবার থেকে সহকর্মী কেউই। অসুস্থ শরীর নিয়ে, একের পর এক শুটিং করে গেছেন তিনি। সকলের নিষেধ সত্বেও নিজের দিকে খেয়াল রাখেননি। স্ত্রী এবং কন্যাসহ ছিল তাঁর সুখের ঘর, চলতি বছর মার্চ মাসে যা তাসের ঘরে পরিণত হল।

অভিষেক চ্যাটার্জী

তরুণ মজুমদার – ‘ভালোবাসা ভালবাসা’য় বেঁধেছিলেন চলচ্চিত্র জগতকে। তবুও মৃত্যুর ‘দহন’ তাঁর অন্তিম ডেকে আনল। ৪ জুলাই জীবনাবসান হয় ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ খ্যাত পরিচালক তরুণ মজুমদারের।

তরুণ মজুমদার

নির্মলা মিশ্র- তোতা পাখি নয়, বরং সকল শিকল ছিন্ন করে নিজেই মায়ের কাছে, মায়ের দেশে পাড়ি দেন নির্মলা মিশ্র। গত ৩০ জুলাই, তাঁর চেতলার বাসভবনে হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। ৩১ জুলাই রাত ১২.০৫ নাগাদ চিকিৎসক তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয় ৮১ বছর। স্বামী, পুত্র এবং পুত্রবধূ নিয়ে ছিল তাঁর ভরাট সংসার।

নির্মলা মিশ্র

ঐন্দ্রিলা শর্মা- উপরিক্ত সকলের চেয়ে বয়সে ছোট, এবং সকলের চেয়ে বেশি যাঁর মৃত্যু এই বছর বাংলার মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়েছে, তিনি অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মা (Aindrila Sharma)। সাড়ে তিন সপ্তাহর লড়াইয়ে, শারীরিক ভাবে হার মানেন ২৪ বছর বয়সী ঐন্দ্রিলা। দু বার তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছিল ক্যান্সার। সাময়িকভাবে জয়ী হলেও, শেষ রক্ষা হয়নি ছোট পর্দার ‘ঝুমুর’ এর।

ঐন্দ্রিলা শর্মা

এছাড়াও বিশ্বের অন্যতম সেরা বোলার শেন ওয়ার্ন থেকে শুরু করে, ছোটবেলার রূপকথার গল্প হ্যারি পটারের অন্যতম ভিত হ্যাগ্রিড ওরফে রবি কল্ট্রেনেরও আকস্মিক প্রয়াণ ঘটে এই বছরে। তাঁদের মৃত্যুও বিশেষ ভাবে নাড়া দিয়ে ওঠে। এমনকি এই বছরে মৃত্যু ঘটেছে ব্রিটেনের মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথেরও।

নতুন বছর যেমন নতুন আলো, আশা নিয়ে আসে, পূরণ বছরও গত হওয়ার সঙ্গে নিয়ে যায় অনেক ভালো থাকা, অনেক ভালো রাখার মত মানুষকে। তবুও আমাদের আগাম ভালোর দিকে তাকিয়েই বাঁচতে হয়। করতে হয় নতুনের অপেক্ষা। কালের নিয়মই এমন। ছেড়ে দিতে হয় জায়গা। তাই সর্বশক্তিমানের কাছে থাকুক এটুকুই ই প্রার্থনা, হাসিমুখ থাকুক প্রিয়জন, এবং “কষ্ট যদি দাও হে প্রভু,শক্তি দিও সহিবারে”।

Scroll to Top