“এমন পিরিতি কভু নাই দেখি শুনি…”

“পরানে পরানে বাঁধা আপনা আপনি..” পার্থিব প্রেমের উৎকর্ষ উদাহরণ হিসেবে, যেন ভিত প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছেন ভগবান শ্রী বিষ্ণুর অষ্টম অবতার শ্রী কৃষ্ণ, এবং তাঁর সখী লক্ষ্মী-রূপী শ্রী রাধা। যুগ যুগান্তর ধরে তাঁদের প্রেম হয়ে উঠেছে সাধনার উপজীব্য। আজ রাধাষ্টমী। ভাদ্র মাসের শুক্ল পক্ষের অষ্টমী তিথিতে, দেবী রাধা জন্ম গ্রহণ করেন। সখা শ্রী কৃষ্ণের জন্মের দু সপ্তাহ পর, ধরাধামে অবতীর্ণ হন কৃষ্ণ-প্রিয়া। পুরাণ মতে, তাঁদের জন্মের পেছনেও ছিল কৃষ্ণ ভক্ত সুদামার অভিশাপ বর্ষন। শত বছর ধরে বিচ্ছেদ যন্ত্রণা সহ্য করেও, রাধা এবং কৃষ্ণ থেকে গেছেন একে অপরের পরিপূরক হয়ে।

পুরাণ অনুসারে, স্রোত অর্থাৎ ধারার বিপরীতে প্রবাহ হবেন বলেই রাধার নামকরণ হয়। যিনি এক ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে ভালবাসার পরশ ছুঁইয়ে দেবেন। সুদামার অভিশাপে গোলকে বিচ্ছেদ হয় শ্রী কৃষ্ণ এবং শ্রী রাধার। পৃথিবীতে জন্ম নেন এই দুই চিরন্তন প্রেমী। বৃষভানু এবং কীর্তিদার কোল আলো করে আসেন দেবী লক্ষ্মীর এই মনুষ্য রূপ! কিন্তু জন্ম থেকে অনেকদিন পর্যন্ত রাধা তাঁর চোখ উন্মোচন করেননি। ঘটনাচক্রে একরত্তি ছোট্ট শ্রী কৃষ্ণের দেখা পেতেই, চোখ খোলেন রাধারাণী। আবারও প্রমাণ পায়, এমন ‘পিরিতি’, সত্যিই মহাবিশ্বে দেখা মেলা ভার!

শোনা যায়, রাধার পায়ে পায়েই রচনা হয়েছিল বৃন্দাবন। জড়ের মধ্যে প্রাণ সৃষ্টি করতেন রাধা। তাঁর ছোঁয়ায় পাথর হত সোনা। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে উপজীব্য করে অনেক সাহিত্যিক সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই রাধার মধ্যে তৎকালীন নারী জাতির প্রতিফলন উঠে এসেছে। উঠে এসেছে নারীর প্রতি নিপীড়ন। রাধার অমতে একাধিক বার কৃষ্ণকে সঙ্গম করতেও দেখা গেছে। তবুও বেশ কিছু কবি বা সাহিত্যিক রাধা কৃষ্ণের প্রেমকে রোম্যান্টিকতার মোড়কেই মুড়তে চেয়েছেন।

পুরাণে রাধার মৃত্যু প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে, রাধার দেহত্যাগের পর শ্রী কৃষ্ণ তাঁর সবচেয়ে প্রাণ প্রিয় বাঁশিটিকে ভেঙে ফেলেন। কারণ রাধা ছিল কৃষ্ণর আত্মা! নিয়তির বিধানে রাধার মৃত্যু শ্রী কৃষ্ণের আগে হলেও, রাধারাণীর মৃত্যু যেন কৃষ্ণের আত্মিক মৃত্যুই ছিল। রাধা শ্রী কৃষ্ণের জীবনের সকল রঙ, ছন্দ নিয়ে চলে গেছিলেন। যে জীবনে রাধা নেই, সেই জীবনে ছন্দ নেই। আর সেই ছন্দের আধার বাঁশি! তাই, যে বাঁশির সুর ভুবন ভুলানো, যে বাঁশি কৃষ্ণের পরিচায়ক, সেই বাঁশিকেই রাধার সঙ্গে বিদায় জানান শ্রী কৃষ্ণ।

পৃথিবীর কোনও সম্পর্কই যেন রাধা কৃষ্ণের মত নয়! কবি চন্ডীদাস এই কথাই মনে করতেন। তিনি বলতেন, তৃষ্ণার্ত চাতক পাখিও অবিরাম অপেক্ষা করে যায় বৃষ্টির ফোঁটার। কিন্তু বৃষ্টির ফোঁটা সে খোঁজ রাখে না। তার সময় না হলে, সে চাতকের তৃষ্ণা নিবারণ করে না। ঠিক তেমনই সূর্য এবং পদ্মের সম্পর্ক! সূর্য উঠলে পদ্ম হাসে, কিন্তু তীব্র শীতলতায় পদ্মের জীবনজ্যোতি নিভলে, সূর্য দিব্যি সুখে থাকে। রাধা কৃষ্ণের প্রেম হল মাছ এবং জলের মত। জল ছাড়া যেমন মাছ বাঁচে না, তেমনই এই দুই প্রেমী একে অপরকে ছাড়া বাঁচে না। তাই, শত বিচ্ছেদ যন্ত্রণা দোসর হলেও, জয়ী হয় কেবল দুই প্রেমীর হৃদয়।

Scroll to Top