আজ দোলযাত্রা! বাংলায় কীভাবে এই বৈষ্ণবীয় প্রভাব তার বিস্তার ঘটিয়েছিল জানেন?

‘ ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল…’ আজ দোল যাত্রা। বাঙালিরা আজ মেতে উঠবেন রঙের উৎসবে। কিন্তু যে রঙের খেলার প্রচলন ছিল শ্রীকৃষ্ণকথায়, সেই রঙের খেলা বাঙালিদের মধ্যে কীভাবে প্রচলিত হল? শুনবেন সেই ইতিহাস? চলুন, আর দেরি না করে বাংলায় দোলের আগমনের ইতিহাস নিয়ে আপনাদের অবগত করা যাক।

বৈষ্ণব ভাবধারা, অর্থাৎ রাধা কৃষ্ণের উৎকৃষ্ট প্রেমের সাক্ষ্য বহন করছে যে আধার, সেখান থেকেই বাংলায় দোলের প্রচলনের সূত্রপাত। মধ্যযুগের একজন বিশিষ্ট সাধক হিসেবে সর্বপ্রথম উঠে আসে চৈতন্যদেবের নাম। যিনি মানবতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বলা বাহুল্য, কৃষ্ণজ্ঞানে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেন। বৃন্দাবনে গিয়ে দেখেন দোলের মাহাত্ম্য। বাংলায় ফিরে তিনি রঙের এই উৎসবের মাধ্যমে চান সকল রকম বর্ণ বৈষম্য মুছে গিয়ে, মানুষ যেন মানবতার রঙে একত্র হয়। তাঁর এই পথ পরবর্তীতে বিশ্ববরেণ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও অনুসরণ করেন।
এছাড়াও, চৈতন্যদেবের জন্ম দোল পূর্ণিমার পূণ্য তিথিতে। কথিত আছে, চৈতন্যদেব ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের অবতার। তাই তাঁর জন্মতিথি উপলক্ষ্যেও দোল উৎসবকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক কারণও নিহিত আছে বাংলার ইতিহাসে। ফাল্গুন চৈত্র মাস নাগাদ বাংলায় পালন করা হয় নবান্ন উৎসব। এই সময় রবি শস্য পেকে ওঠার মাহেন্দ্রক্ষণ। বাঙালি জাতি অন্নের দেবী, অন্নপূর্ণার আরাধনা করে থাকেন এই সময়। ফলে এক বিশেষ আনন্দ যজ্ঞের সমাহার ঘটে দোলের সময়কালে। রঙের খেলা, বাঙালির এই আনন্দ আয়োজনের যেন এক বিশেষ অনুঘটক হয়ে ওঠে। বাংলা মাসের শেষ উৎসব হিসেবে তাই, দোল পালন করা হয় বেশ সমারোহে।

১৬৯০ সাল নাগাদ পুরনো গ্রাম বাংলায় দোল উৎসবের বিশেষ প্রচলন ছিল। বিশেষ করে নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর জাতীয় অঞ্চলগুলিতে।
জোব চার্নক তৃতীয়বারের মত কলকাতায় এসে, সাক্ষী হন এমনই এক দোল উৎসবের। কলকাতার এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে দেখেন, এক দীঘির পাড়ে মঞ্চ বানিয়ে দুদিকে রাখা হয়েছে শ্রীরাধা এবং শ্রীকৃষ্ণর দুটি মূর্তি। তাঁদেরকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে জনসমাগম। চারিদিক আবীরের রঙে রাঙা হয়ে আছে। বেশ জমজমাটি এক মেলা গড়ে উঠেছে এই রঙের উৎসব ঘিরে।

এছাড়াও প্রাচীন কলকাতায় দোল উদযাপনকে কেন্দ্র করে নগরবাসী দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত হন। একদল, বাবু কালচারের অন্তর্গত, আর একদল সাধারণ মানুষ।
বাবু কালচারের অন্তর্গত ব্যক্তিবর্গের দোল মূলত ভোগবিলাস কেন্দ্রিক হত। কৃষ্ণ পুজো, কীর্তন, ভোগ বিতরণ, গান বাজনা দিয়ে শুরু হলেও, তাঁদের বাগান বাড়িতে বাইজি নাচের সহযোগে চলত রঙ খেলা। সঙ্গে দোসর হত পান বিলাস।

অপরদিকে সাধারণ মানুষেরা খোল করতাল নিয়েই পথে পথে রঙের উৎসবে মেতে উঠতেন। রংহীন খুব কম মানুষই থাকতেন সেদিন। এমনকি কিছু মানুষ সঙ সেজে, গান গেয়ে মেতে উঠতেন বসন্ত উৎসবে। এইভাবেই পুরাতন বাংলা থেকে দোলের প্রচলন তার বিস্তার লাভ করে।

Scroll to Top