“পূজিতা মুনিভিঃ সর্ব্বৈ, ঋষিভিঃ স্তূয়তে সদা।” তিনি, শ্বেত পদ্মাসনা দেবী, দেবী সরস্বতী। যাঁর আরাধনায় ব্রতী হন সকল বয়সী মানুষ। বিদ্যার দেবী তিনি, সকলকে জ্ঞান প্রদান করবেন এমনই মনোবাঞ্ছা নিয়ে আবর্তিত হয় বসন্ত পঞ্চমী, অর্থাৎ দেবী সরস্বতীর পুজো। কিন্তু জানেন কি, দেবী সরস্বতীর জীবন মোটেই মসৃণ নয়! বরং তিনি স্বতন্ত্র, আত্মনির্ভর, বিদুষী বলে যাবতীয় দুর্ভোগেরও শিকার তাঁকে হতে হয়েছে। আজকের বিশেষ পর্বে তাঁর জীবনের কিছু টুকরো উপাখ্যান ভাগ করে নেব আপনাদের সঙ্গে।
মৎস্যপুরাণে রয়েছে দেবী সরস্বতীর জীবনের সবচেয়ে ‘ট্র্যাজিক’ কাহিনী। আপন কন্যা সরস্বতীর রূপ যৌবনের প্রতি অভিলাষী হয়ে ওঠেন স্বয়ং পিতা ব্রহ্মা। ফলে তিনি উদ্যত হন তাঁর মানস পূত্রির সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার জন্য। দেবী সরস্বতী প্রাণপণে বাঁচতে চাইলেও, চারিদিকে রক্তবীজের মত জন্ম নিতে থাকে ব্রহ্মার মাথা। পরিশেষে এই অনাচারের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয় অসহায় কন্যাকে। যদিও পূত্রী মনসার প্রতি সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার কামনা শিবের মধ্যেও লক্ষিত হয়েছে। আসলে এই সকল উপাখ্যানের বিষয়বস্তু সমাজ থেকেই গৃহীত, সুতরাং সমাজের প্রতিচ্ছবিই ফুটে উঠতে বাধ্য।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের মতে, সরস্বতীর জন্ম হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণের জিহ্বা থেকে। কিন্তু দেবী সরস্বতী মুরলী মনোহরের অনিন্দ্যকান্তি রূপের প্রতি মুগ্ধ হয়ে, প্রেম নিবেদন করে বসেন। এদিকে কৃষ্ণ রাধা নিবেদিত প্রাণ। সরস্বতীকে পরিত্যাগ করে, তাঁকে পাঠিয়ে দেন বৈকুণ্ঠে বিষ্ণুর কাছে। সেখানেও নারায়নের প্রেয়সী রূপে অবস্থান করছেন লক্ষ্মী এবং গঙ্গা। নারায়ণ লক্ষ্মী-প্রিয়, কারণ লক্ষ্মী দেবী সরস্বতীর মত চপল নন। দেবী সরস্বতী স্পষ্টবাদী, কিন্তু লক্ষ্মী হলেন লক্ষ্মীমন্ত। তাই সমাজে তাঁর কদর বেশি। ফলে বৈকুণ্ঠ থেকেও সরস্বতী হলেন বহিষ্কৃতা। স্বামী পরিত্যক্তা সরস্বতীকে লাভ করলেন বৃদ্ধ ব্রহ্মা। প্রমাণ হল, সমাজে স্পষ্টবাদী নারীর জীবনে মনের মত প্রণয় আসে না, যা আসে তা কেবল তাঁর শরীর ভোগের কামনা পূরণ।
![](https://techtalkey.com/wp-content/uploads/2023/01/img-20230126-wa00015737311978188610455-1024x879.jpg)
আগমতত্ত্ববিলাসে রয়েছে দেবী সরস্বতীকে নিয়ে আরও একটি হৃদয় ব্যথিত উপাখ্যান। ব্রহ্মা, বিষ্ণু বা কোনও ঋষি মুনি নন, অসুরদের দ্বারা তাঁকে নিগৃহীত হতে হয়। হলাহল অসুরগণ তাঁকে পাতালে নিয়ে এসে নাগপাশে বেঁধে, বিষকূপে ডুবিয়ে রাখেন। পরবর্তীতে নারায়ণ দ্বারা রক্ষিত হলেও তাঁর শরীর অত্যধিক বিষ গ্রহণে নীল হয়ে যায়।
এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, সরস্বতীকেই কেন এত দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে! একটু গভীর ভাবে আমরা যদি ভাবি, দেখব যে ভগবান ‘কনসেপ্ট’ মনুষ্য সৃষ্ট। দেব দেবী হলেও, মানুষ যখন তাঁদের উপাখ্যান লিখছেন, তখন সমাজ সেখানে প্রতিষ্ঠিত হবেই। কারণ সাহিত্য বা শিল্প সমাজেরই দর্পণ। সরস্বতী বিদ্যার দেবী, বিদুষী নারী। যে সময় তাঁর উপাখ্যান রচিত হচ্ছে, সেই সময় সমাজে নারী শিক্ষা মহাপাপ। ভুল করেও কোনও নারী শিক্ষার জন্য অগ্রসর হলে তাঁর কপালে জুটত পারিবারিক থেকে সামাজিক নির্যাতন। নারী মাত্রই যেন সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র! নারী মানে যে একজন মানুষ, সে ধারণা তখনকার পুরুষতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীদের কাছে অ-লৌকিক ছিল। যে কারণে সমাজের নৃশংস ছবিই ফুটে উঠেছে দেবী সরস্বতীর জীবন চরিতে।