জিম করবেটের জীবনের, এক রোমাঞ্চকর শিকারের অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকুন আপনিও

প্রবাদে আছে, ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা’.. আর এই প্রবাদের সঙ্গেই খানিক অ-সখ্যতা যাপনে মগ্ন হয়ে, এডওয়ার্ড জেমস করবেট ওরফে জিম করবেট উদ্যত হয়েছেন, একের পর এক শিকার অভিযানে। ‘শিকারি’ হয়েও, তিনি ছিলেন আদ্যপান্ত পশুপ্রেমী। বলা বাহুল্য, তাঁর শিকারগুলি মোটেই স্বার্থান্বেষনের দায় ছিলনা। তা ছিল যথার্থরূপে মানুষের হিতের দায়!
জিম করবেটের জীবনের বেশ কিছু রোমাঞ্চকর শিকারের মধ্যে অন্যতম, কুমায়নের পানারের, মানুষখেকো বাঘ শিকারের কাহিনী। এর জন্য আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে শতবর্ষের এক যুগ আগে। সময়টা ১৯১০ নাগাদ। কুমায়নের আলমোড়ার পানার গ্রামে, হঠাৎ করে আবির্ভূত হন ‘যমদূত’! ‘ক্যাট ফ্যামিলি’ র অন্যতম ভয়ংকর সদস্য, চিতা। প্রসঙ্গত, উনিশ শতকের প্রথমদিকে, পানার কবলিত হয় ভয়ংকর কলেরার দুর্ভোগ দ্বারা। মৃত্যু মিছিলে স্তব্ধ হয়ে ওঠে গ্রামের পরিবেশ। মৃতদেহগুলিকে সৎকার করা হতে থাকে পাশের একটি নদীতে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পানার আমন্ত্রণ জানায়, তাঁদের আসন্ন বিপদকে।


কুমায়নের বেশিরভাগ স্থানই তখন জঙ্গল দিয়ে ঘেরা থাকতো। পানারও তার ব্যতিক্রম ছিলনা। পানার সংলগ্ন জঙ্গলটিতেই বাস ছিল পানারের ‘যমদূত’ , চিতা বাঘটির। সেই জঙ্গলে অন্যান্য প্রাণী সংখ্যা কম হওয়ায়, চিতাটির শিকারের কেন্দ্র হয়ে ওঠে, নদীতে ভেসে থাকা মৃতদেহগুলি।


কালক্রমে পানার কলেরামুক্ত হলে, মৃতদেহ সংখ্যা কমতে থাকে, ফলে চিতাটির যথেচ্ছভাবে খুদা নিবৃত্তি ঘটতে অক্ষম হয়। মানুষের, মাংসের স্বাদ, চিতা আর সম্বরণ করতে পারেনি। আস্তে আস্তে শিকার হতে থাকে, গ্রামের জীবন্ত মানুষেরা। প্রায় চারশো জনের মত মানুষ প্রাণ হারান চিতার আক্রমনে।
তখন করবেট, তাঁর অন্যতম রোমাঞ্চকর অভিযান, চম্পাবতের মানুষখেকো বাঘিনী শিকারে নিযুক্ত আছেন। এমতাবস্থায় তিনি পানারের শোচনীয় দুর্দশার খবর শোনেন। প্রস্তুতি নেন, চিতাটিকে শিকারের। এর মধ্যে, সদ্য বিবাহিত এক দম্পতির বাড়ি চিতাটি আক্রমণ করে। নব বিবাহিতা বধুটি ছিল তার লক্ষ্য, কিন্তু স্বামীর তৎপরতায় চিতার নাগাল থেকে বধুটিকে উদ্ধার করলেও, চিতার ছোবলে বধুটি মরণাপন্ন হয়ে যান। করবেট চিতাটির গতিবিধি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করার জন্য, সেই নবদম্পতির বাড়িতে পরের রাতে আশ্রয় নেন। যথাযথ তথ্য সংগ্রহ করে, শুরু করেন তাঁর ‘মিশন’।


চিতাটিকে বাগে আনার জন্য, চারটি ছাগলকে অস্ত্র করেন করবেট। যাতে তার লোভে চিতাটি ধরা পড়ে। কিন্তু বাঘ ও কম যায়না, ধূর্ততা ও সচেতনতার দরুন, একটি ছাগল শিকার করেই সে আত্মগোপন করে। ব্যর্থ হয় সেইদিনের মিশন। পরেরদিন জিম, একটি ছাগলের পরিবর্তে দুটি ছাগলকে ‘টোপ’ হিসেবে ব্যবহার করেন। চিতাটি একই পদ্ধতিতে ঘন জঙ্গলে শিকার নিয়ে মিলিয়ে যায়। এবারে আর জিম ছাড়ার পাত্র নন, আরও তিনজন সঙ্গীকে নিয়ে মধ্যরাতে সেই ‘যমদূত’ এর সন্ধানে গমন করেন। নিঃশব্দে, ঠান্ডা মাথায় এগিয়ে যান গন্তব্যের দিকে। জিমের হাতে কেবল ছিল রিভলবার, এবং বাকিদের হাতে ছিল টর্চ। সঙ্গীদের কেবল বলেন, তাঁরা যেন ভীত হয়ে, স্থান ত্যাগ না করেন। কিন্তু কথাতেই আছে,, ‘যেখানে বাঘের ভয়…’ সেখানেই দিকবিদিক শূন্য হয়। আচমকা সেই অ-খ্যাতনামা ‘যমদূত’ এর দর্শন পেয়ে, জিমের তিন সঙ্গী প্রাণপণে এদিক ওদিক দৌড়ে পালিয়ে গেলেন। ঘটনার আকস্মিকতা এতই আচমকা ছিল, যে জিমের এক সঙ্গী টর্চ ফেলেই চম্পট দিয়েছিলেন, আর তাতেই হল জিমের কার্যসিদ্ধি। কোনরকমে গভীর জঙ্গলে সেই টর্চের আলোয়, বাঘটিকে তিনি গুলিবিদ্ধ করেন। বুকে গুলি লাগে তার, সেখানেই প্রাণ হারায় এই প্রানঘাতক।

জিম করবেট, এবং দুঃসাহসিকতা, একই মালার দুই ফুল। মানুষের জীবনের রক্ষার্থে, নিজের জীবন কে মৃত্যুর দরবারে পৌঁছনো থেকে কক্ষণো বিরত থাকেননি তিনি। বাঘের মুখে ব্যাকটেরিয়া থাকে, যার ফলে অধিকাংশ আক্রান্ত প্রাণীর সংক্রমণে মৃত্যু ঘটে, এবং বাঘের একটি থাবাই এত গভীর হয় যে বাঁচার কোনো সম্ভাবনাই থাকেনা। সমস্তটা জেনেও তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন প্রাণঘাতী বাঘকে নির্মূল করার অভিপ্রায়। শিকারের জন্য হেঁটে যেতেন মাইলের পর মাইল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি জঙ্গলে, নিঃসঙ্গতা পছন্দ করতেন, কখনো সঙ্গী করতেন তাঁর সারমেয়টিকে। জিম করবেটের মত সম্পদ, আমাদের দেশে খুব কমই আছেন। তাঁর সংযম, কৌশল, তৎপরতা, আত্মনিবেদন, সমস্তটাই আমাদের ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম ভিত হয়ে থাকবে।

Scroll to Top